রূপেণ বাবু, আমার ইংরেজির স্যার, বলেছিলেন এক আশ্চর্য বাক্য, আলেক্সান্ডার দ্যুমা-কে ধার করে – Nothing succeeds like success.
এসব কথা আমি শুনিনি যদিও। স্বকর্ণে। কারণ, নিয়ম মাফিক সেদিনও ইংলিশ টিউশনিতে ডুব মেরেছিলাম আমি। কমলা টকিজ-এ সেদিনই স্রেফ রাতের শো’তে দেখাচ্ছে টোটাল এডাল্ট পিকচার–’বক্সিং-হেলেনা’। হাতা গুটিয়ে মারামারি করে, তিন ডবল দামে ব্ল্যাকে টিকিট কেটে, ‘নাম্বার টেন’ সিগারেট ধরিয়ে শেষমেশ সেকেন্ড ক্লাসে দেখেছিলাম সেই সিনেমা আমি। এবং বাড়ি ফিরে ঘন্টা তিনেক টুকটাক বই-টই আর তারপর ব্যাপক ঘুম।
সেটা 1997। আমার মাধ্যমিক পরীক্ষার তখন ঠিক এক বছর দেরি। ফল যা হওয়ার তাইই হয়েছিল। নিজের ইস্কুলের এগারো নম্বরে নাম ছিল আমার মেধা তালিকায়। বাবা, কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছিল তিন মাস। মা, দিন রাত কাঁদতো। আর পড়শীরা বলতো– এ ছেলের কিস্যু হবে না! বখে গেছে…গোল্লায় গেছে!
*****
দিনকতক পরের কথা। সায়েন্স নিয়েছি। নিজের স্কুলেই। আর ফিজিক্স টিউশনিতে নাম লেখাবার জন্য গেছি বারিদ-বাবুর বাড়ি। স্যার পত্রপাঠ বিদায় করে দিলেন– কত পেয়েছিস? এহঃ! তোর তো আর্টস নিয়ে পড়া উচিৎ!
কষ্ট বা রাগ কোনোটাই হয়নি। বরং বিন্দাস বাই-সাইকেল নিয়ে চলে এসেছিলাম সিধা নিউ সিনেমায়। সিগারেট ধরিয়ে দেখে ফেলেছিলাম মীরা নায়ারের চরম পানু ছবি– কামাসূত্রা।
টিউশনিতে যদিও চান্স পেয়েছিলাম তৎকালীন ‘সেকেন্ড গ্রেড’ টিচারদের বাড়িতে। এবং রূপেনবাবু-স্যার যদিও এবারেও ঠাঁই দিয়েছিলেন আস্তানাতে। কিন্তু তাতে কী? স্বভাব আমার একই রকম। আ-জনম। কোনো টিউশনিতেই নিয়মিত যেতাম না। বরং পানু সিনেমা দেখতে যেতাম নাইট শোতে। সঙ্গে সিগারেট আর সাইকেল সখ্য অটুট। আর বাড়ি ফিরে ওই ঘন্টা তিনেকের টুকটাক পড়াশুনা। একইরকম। যেমন করেছিলাম মাধ্যমিকের সময়ে।
যদিও এবারে ফলাফল বদলে গেল। উচ্চ-মাধ্যমিকে ইস্কুল তো বটেই, ডিস্ট্রিক্ট টপার তো বটেই এমনকি রাজ্যের মেধাতালিকাতেও একটা স্থান চলে এলো আমার। এবং জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষায় ৬২ তম সফল প্রতিযোগী।
সেবারে বাবা কিনে দিয়েছিল সুনীলের ‘একা এবং কয়েকজন’। সেবারে মা– সর্বদা সেজেগুজে থাকতো ইন্টারভিউ নিতে আসা সাংবাদিকদের কথা ভেবে। আর সেবারে পড়শীরা বলতো– জুয়েল ছেলে বুঝলে? অসম্ভব স্মৃতিশক্তি! আজ ব’লে তো না…সেই ছোটবেলা থেকে তো দেখে আসছি ওকে!
****
টুকটাক কথাটা ব্যবহার করেছি আমি বার দুয়েক অদ্যবধি। কিন্তু সে টুকটাক ছিল না মোটেই। কোনোদিনও না। বইয়ের পাতা খুললে আমার দিগ্বিদিগ জ্ঞান থাকতো না মোটে। আমি তন্ময় হয়ে নদীখাতের চিত্র দেখতাম মাধ্যমিকে।।আর আমিই একাগ্র চিত্তে পুকুরের নিচ থেকে উঠে আসা বুদবুদের ব্যাসার্ধ কষতাম পাতার পর পাতা জুড়ে উচ্চ মাধ্যমিকে।
*****
ইউসুফ ডিকেছ, হ্যাঁ এটাই নাম এবং উচ্চারণ ওঁর তুর্কি ভাষায়,২০০৮ থেকে সামার অলিম্পিকসে অংশগ্রহণ করে যাচ্ছেন একই রকম ভাবে। কেউ ফিরেও তাকায়নি। দৃকপাত মাত্রও করেননি এমনকি খেলা-বোদ্ধারা।
ষোল বছর পরে ভদ্রলোক মেডেল জিতেছেন। আর সঙ্গে সঙ্গে ভাইরাল তিনি। শত শত গাথা তাঁর নামে, সত্যি এবং মিথ্যে। হাজার হাজার প্রেম নিবেদন। যেসব পড়ে হয়ত মুচকি হাসছেন ভদ্রলোক।যেরকম হেসেছিলাম আমিও একদিন।
****
নীতিশিক্ষা কী পেলেন?
হেরে গেলে আপনি–দুয়ো।
আর জিতলেই– গুরুদেব জিয়ো!
অতএব লেগে থাকুন। জিততেই হবে। হবেই। এ বাদে, বিশ্বাস করুন– সকলই ফক্কা।
(তুর্কিকে আপনি যতই কায়দা মেরে ‘টার্কি’ বলে ডাকুন, এ দেশের লোকেরা নিজেদের ‘তুর্কি’ই বলে সম্বোধন করে। এটাই স্থানীয় উচ্চারণ।)