একটা প্রশ্ন আমাকে সবসময় খুব আকর্ষণ করে, বস্তুর কি মন আছে? চেতনা আছে? আমরা এই মহাজাগতিক সবকিছুই যদি কিছু মৌলিক পদার্থের সমবায়ে তৈরি তবে আমাদের মন থাকলে কেন ওই বই বা পাহাড়ের মন থাকবে না? আপনি বলবেন থাকবে না কারণ আমরা সব পদার্থের এমন মিশ্রণে তৈরি যে এই মহাবিশ্বে একটা অলৌকিক জিনিস সৃষ্টি করেছে তা জীবন। পদার্থেরা তো জীবিত নয়। ওদের প্রাণ নেই।
সে তো জানিই। তবু মনে হয় এদের ভেতর এত রহস্য, এত জটিলতা- এই অব্যক্ত কণাগুলোও যেন কিছু বলে উঠতে চায়। তারা যেন অপেক্ষা করে থাকে কোনো চেতনার যারা তাদের অহল্যার মত জাগিয়ে দেবে। অচেতন বস্তুর ওপর চেতনের ধর্ম আরোপ করাকে অলংকার শাস্ত্রে বলে সমাসক্তি অলংকার। আপনি ভাবতেই পারেন এই লেখার ভূমিকাও যেন ক্রমশ সেইদিকেই যেতে চলেছে।
সাধক দার্শনিক বলেছেন এই জগত মায়ার। সাধক তাই সাধনার মধ্যে দিয়ে সত্য অন্বেষণের চেষ্টা করছেন। মায়ার বাঁধনে তিনি জড়াবেন না কিছুতেই। বিজ্ঞানী সত্য অন্বেষণের চেষ্টা করছেন প্রশ্নের মাধ্যমে। দার্শনিকও তাই। তিনি প্রশ্ন করেছেন, কে আমি? কোথায় মোরে যেতে হবে কেনই বা আমি আছি? খুব মৌলিক প্রশ্ন। যিনি এমন প্রশ্ন করেন একটা একজিস্টেনশিয়াল ক্রাইসিস তাকে ঘিরে রাখে। সত্তার একটা নিরাপত্তাবোধহীনতা তাকে জর্জরিত করে সবসময়। দার্শনিক চিন্তা ও যুক্তির জালে সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেন।
বিজ্ঞানীর প্রশ্নও এমন। সরল আপাত হাস্যকর। আইজ্যাক নিউটন নিজেকে দুটি প্রশ্ন করেছিলেন। আপেল গাছ থেকে মাটিতেই পড়ে কেন? আপেল যদি মাটিতেই পড়ে তবে চাঁদ কেন পৃথিবীতে এসে পড়ছে না? তিনি এর উত্তর খোঁজার চেষ্টা করলেন। তাঁর বয়স তখন সবে তেইশ। তিনি বুঝলেন প্রথাগত গণিতের সাহায্যে একে ব্যখ্যা করা যাবে না। তাই তিনি তখন ক্যালকুলাস আবিষ্কার করলেন। ইংলন্ডে তখন প্লেগের আক্রমণ শুরু হয়েছে। তিনি ফিরে গেছেন নিজের গ্রামের বাড়িতে। ওই একটি প্রশ্নই বিজ্ঞানের ধারাকে এক ধাপে বহু বছর এগিয়ে নিয়ে গেল। আমরা জানলাম এক অভূতপূর্ব বলের কথা- মহাকর্ষ।
আইনস্টাইন যখন জার্মানির এক অফিসে সামান্য কেরানির চাকরি করেন কাজের ফাঁকে জানলা দিয়ে যখন দেখলেন এক যুবক মইয়ে উঠে জানালার কাঁচ পরিষ্কার করছে তখন তাঁর মনে হল ছেলেটি যদি হঠাৎ মই থেকে পড়ে যায় তবে তার কি হবে? মহাকর্ষের ভূমিকাই বা কি হবে এই ক্ষেত্রে? এই একটি প্রশ্ন পরবর্তী বহু বছরের বিজ্ঞানের রূপরেখা একদম বদলে দিয়েছিল। তিনি নির্ভীককন্ঠে বললেন, মহাকর্ষ ঠিক তেমন বল নয় যেমনটি নিউটন বলে গেছেন। আমি গাড়ির সিটে বসে আছি মহাকর্ষ আমাকে চেপে রেখেছে বলে নয়। আমি গাড়িতে বসে থাকার জন্য স্পেস-টাইমের মধ্যে যে অতি অতি সামান্য বক্রতা সৃষ্টি করছি সেটাই মহাকর্ষ।
আইনস্টাইনও বুঝলেন তাঁর এই নতুন তত্ত্ব প্রমাণ করতে হলে সাধারণ দ্বিমাত্রিক জ্যামিতি দিয়ে হবে না। তাই বক্রতলের জ্যামিতির সাহায্যে এটিকে ব্যাখ্যা করলেন। কিন্তু কে সেই জার্মানির অখ্যাত কেরানির পেপার পড়ে দেখবে? তাও সে কিনা বলছে নিউটনের মহাকর্ষ একটা ভুল ধারণা! জেনারেল রিলেটিভিটির তত্ত্ব অবজ্ঞায় পড়েই থাকল অনেক বছর। যখন তার উদ্ধার হল বিজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গি আমূল পালটে গেল।
বিজ্ঞানীরা যখন পরমাণুর একদম কেন্দ্রে লক্ষ্য করলেন তখন দেখলেন কণাগুলো সেখানে অদ্ভুত আচরণ করছে। সেই আচরণকে কিছুতেই চালু গণিত বা আইনস্টাইনের তত্ত্ব দিয়েও ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না। অথচ আলো যেহেতু সেই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণিকাদের দিয়ে প্রতিফলিত হয় না তাই তাদের দেখাও যায় না। কিন্তু পরিমাপ করা সম্ভব। তাই তারা তাদের পরিমাপ করার জন্য প্রচলিত গণিত ছেড়ে সহায়তা নিলেন পরিসংখ্যান বা স্ট্যাটিসটিক্সের। ধীরে ধীরে কোয়ান্টাম মেকানিক্স তার ডালপালা মেলতে শুরু করল।
মানুষ সেই প্রথম শুনল বিজ্ঞানীরাও নানান অদ্ভুত কথা বলেন। তারা বলেন একই সাথে কোনো কণার উপস্থিতি থাকতেও পারে আবার নাও থাকতে পারে। একটি কণা একই সাথে ডান থেকে বামে আবার তেমনি বাম থেকে ডান দিকেও ঘুরতে পারে। এটা কখনও সম্ভব? আইনস্টাইনও একে মেনে নিতে পারলেন না। ঈশ্বর ও জুয়াখেলার কথা বললেন। কিন্তু কোয়ান্টাম ফিজিসিস্টরা লেগে রইলেন। আজ আমরা যে লেসার, কম্পিউটারের সিলিকন চিপ, জিপিএস, আই টি, এম আর আই এসব শুনছি ও দেখছি এগুলো সবই কোয়ান্টাম মেকানিক্সের দান।
যে বিগ ব্যাং থেকে মহাবিশ্বের সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করা হয় সেই বিগ ব্যাং-এর ঠিক পরের অবস্থা বা ব্ল্যাক হোলের সিঙ্গুলারিটি জেনারেল রিলেটিভিটি দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। তাদের ব্যাখ্যা করতে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের সাহায্য নেওয়া ছাড়া উপায় নেই।
তবে কি জেনারেল রিলেটিভিটি ভুল? আইনস্টাইন ঠিক কথা বলেন নি? নাকি কোয়ান্টাম মেকানিক্স ভুল? নাকি দুটোই ঠিক তাদের মধ্যে যোগাযোগের একটা সুতো খোঁজা দরকার। বিজ্ঞানীরা গত চল্লিশ বছর ধরে সেই সুতোই খোঁজার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। আমাদের মহাবিশ্বের চারটি প্রধান বল মহাকর্ষ, ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক, উইক ও স্ট্রং ফোর্স এই চারটি বলকে স্ট্যান্ডার্ড মডেলের সব কণাদের একই সাথে ব্যাখ্যা করা যাবে, জেনারেল রিলেটিভিটি ও কোয়ান্টাম মেকানিক্সকে একই সাথে ব্যাখ্যা করা যাবে এমন সাধারণ কোনো তত্ত্বকে বিজ্ঞানীরা খুঁজে চলেছেন দীর্ঘদিন ধরে।
সেটাই প্যান্ডোরার বাক্স। থিওরি অফ এভরিথিং। বিজ্ঞান এখনও তার কতটা কাছাকাছি পৌঁছেছে? সত্যিই কি সেই থিওরির অস্তিত্ব থাকা সম্ভব?
(চলবে)