আমরা আগের দুটি আলোচনায় যতদূর এগিয়েছি তাতে মহাবিশ্বের উৎপত্তি ও আমাদের চারপাশের প্রধান বলগুলো নিয়ে আমাদের খুব প্রাথমিক একটা ধারণা হয়েছে। এই ধারনার ওপর সম্বল করে আমরা প্রায় একটা অসম্ভব কাজ এখন শুরু করতে চলেছি। আমরা আমাদের সামান্যতম জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা দিয়ে সময়কে বোঝার চেষ্টা করব। সময় বা টাইমের ধারণা একটা এনিগমা, ধাঁধাঁ কিন্তু আইনস্টাইনের আগে বিজ্ঞানীরা এই নিয়ে কোনো চিন্তাই করেন নি। সময়ের ধারণা অর্জন করতে আমরা আইনস্টাইনের স্পেশাল থিওরি অফ রিলেটিভিটির দিকে ফিরে তাকাব। আমার মত ‘নেইভ’ লোকের পক্ষে এটা খুব কঠিন প্রায় অসম্ভব কাজ। আমি ধরে নিয়েছি আপনিও আমার মতই। তাই চলুন আগামি কিছুক্ষণ আমরা সেই অসম্ভবের জগতে প্রবেশ করি।
আইনস্টাইনের সময় ফিজিসিস্টরা খুব নিশ্চিন্ত ছিলেন যে এই পৃথিবীর সব রহস্যের সমাধান তারা করেই ফেলেছেন। বিজ্ঞানের আর কিছুই জানার বাকি নেই। নিউটনের তত্ত্ব দিয়ে গ্রহ-নক্ষত্রের গতিবিধি খুব খুব সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে। ম্যাক্সওয়েলের তড়িচ্চুম্বকীয় তত্ত্ব দিয়ে অন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বল ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিজমের ব্যাখ্যা করা গেছে। সেই ইলেক্ট্রিসিটির ওপর ভিত্তি করে ইউরোপে এক বিরাট বড় শিল্প বিপ্লব ঘটে গেছে যা কিনা আমাদের মানব সভ্যতার ধারাকে, সংস্কৃতি ও চিন্তার জগতকে আমূল বদলে দিয়ে গেছে।
১৮৯০ সাল। আপনি যদি এই মুহূর্তে টাইম মেশিনে করে উত্তর ইটালির টাসকান প্রদেশের পাহাড়ি মফসসলে এক বিকেলে চলে যান তবে হয়ত দেখতে পাবেন মাথায় ঝাঁকরা চুল নিয়ে কোনো এক বালক নিমীলিত সূর্যালোকের দিকে নিঃসীম সপ্রশ্নভাবে তাকিয়ে আছে। এই বালকটিকে জার্মানির স্কুল থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে কারণ সে উল্টোপাল্টা প্রশ্ন করে ক্লাসের শিক্ষকদের বিরক্ত করে। তার ‘অবাস্তব’ প্রশ্নের ঠেলায় শুধু যে শিক্ষকেরা তাই নয় ছাত্রদেরও পড়ার অসুবিধে হয়। তাই তাকে এই বলে বিতাড়িত করা হয়েছে যে তার দ্বারা আর যাই হোক লেখাপড়া হবে না। উল্টে সে ক্লাসে থাকলে অন্য ছাত্রদের পড়ার অসুবিধে হয়।
তাই সে ভবঘুরের মত ঘুরতে ঘুরতে ইটালিতে চলে এসেছে। সূর্যালোকের দিকে অপলক চেয়ে থেকে তার মনে একটা প্রশ্ন জেগে উঠেছে, তার নিজের কি হবে যদি সে এখন ওই আলোর গতিবেগে ছুটতে শুরু করে? খুব অমূলক, সাধারণ একটা প্রশ্ন কিন্তু এই প্রশ্নটাই আগামি একশ বছরের বিজ্ঞানের ইতিহাস বদলে দেবে। অন্যরা মাথার চুল ছিঁড়তে ছিঁড়তে ভাববে সত্যি এই প্রশ্নটা আগে আমার মাথায় আসে নি কেন? এই বালকটিই আজ থেকে ১৫ বছর পরে যখন স্পেশাল থিওরি অফ রিলেটিভিটি আবিষ্কার করবে সারা পৃথিবীর সময়কালের ধারণাই আমূল বদলে যাবে।
বাইবেল বলেছে আজ থেকে প্রায় চার হাজার বছর আগে ঈশ্বর পৃথিবীর সৃষ্টি করেন। বিবিসির মিচিও কাকুর সাথে ‘টাইম’ নামে একটা খুব সুন্দর ডকুমেন্টারি আছে। সেখানে তারা দেখাচ্ছেন যে কলোরাডো নদীর দীর্ঘকালীন ক্ষয়ের ফলে যে অত্যাশ্চর্য গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন সৃষ্টি হয়েছে সেই গভীর গিরিখাত আজ থেকে প্রায় ৭ কোটি বছর আগে থেকে তৈরি হওয়া শুরু হয়েছে। ৭ কোটি বছর! হ্যাঁ, তাই। আর সেই ক্ষয়ের ফলে শিলাস্তরের যে গায়ে যে দাগ পড়ে সেই দাগে আপনার কনিষ্ঠ আঙ্গুলের অর্ধেক যতটা হয় ততটা ক্ষয় হতে আমাদের মানব সভ্যতার আদি থেকে এখন পর্যন্ত সময় পার হয়ে যাবে। ভেবে দেখুন সেপিয়েন্সের জয়যাত্রার সময় ওইটুকু মাত্র। ওই বিরাট গভীরতায় আমাদের সময়কাল অর্ধেক কনিষ্ঠা পরিমাণ মাত্র।
তাহলে এই গ্র্যান্ড ক্যানিওনের বয়স যদি ৭ কোটি বছর হয় তবে এই বুড়ো পৃথিবীর বয়সই বা কত? আরো একটু সাহস নিয়ে জিজ্ঞাসা করাই যায় এই মহাবিশ্বের বয়সই বা কত? আইনস্টাইনের সময় বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করতেন সময়কে আমরা ঘড়িতে মাপতে পারি। দূরত্বকে পরিমাপ করতে পারি স্কেল দিয়ে। গতিবেগ মাপতে হলে দূরত্বকে সময় দিয়ে ভাগ করলেই হল। খুব ছোটবেলায় আপনার হয়ত পাটিগণিতের সময়-দূরত্বের অঙ্কের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। মজার কথা হল আইনস্টাইনের স্পেশাল রিলেটিভিটি বুঝতে হলে এর বেশি আর কিছু আমাদের না বুঝলেও চলবে।
তারা তখন আরো মনে করতেন আলো একটি তড়িচ্চুম্বকীয় তরঙ্গ যা শূন্যস্থানে ইথার নামক এক অদৃশ্য মাধ্যমের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়। তড়িচ্চুম্বকীয় তরঙ্গের আবিস্কর্তা ম্যাক্সওয়েল বলে গেছেন শূন্য মাধ্যমে আলোর গতিবেগ অপরিবর্তনীয়। পর্যবেক্ষকের অবস্থান যাই হোক না কেন আলোর গতিবেগের কখনও পরিবর্তন হবে না। আলোর গতিবেগও ততদিনে আমরা জেনে গেছি ১ লক্ষ ৮৬ হাজার মাইল প্রতি সেকেন্ড।
আইনস্টাইনের গুরু ছিলেন দুজন। একজন আইজ্যাক নিউটন অন্যজন জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল। নিউটনের গতিবিদ্যার মৌলিক ধারণা দিয়ে আমরা একটা সাধারণ ভাবনার পরীক্ষা করি। মনে রাখবেন আইনস্টাইনের তত্ত্বের সর্বত্রই এই ‘গেডানকানএক্সপেরিমেন্ট’ (Gedankenexperiment) বা ‘ভাবনার পরীক্ষা’। আমরা যত রিলেটিভিটির ভেতরে প্রবেশ করব তত এই ধারনার সাহায্য নেব।
ধরুন আপনি রেল স্টেশনে দাঁড়িয়ে আছেন। একটি ট্রেন ৬০ কিমি/ঘন্টা গতিবেগে আপনাকে অতিক্রম করল। আপনার কাছে ট্রেনের গতিবেগ ৬০ কিমিই মনে হবে। আরেকটি ট্রেন যদি ৪০ কিমি/ঘন্টা গতিবেগে সেই ট্রেনটির একই দিকে বা বিপরীত দিকে আসে তাহলেও কি প্রথম ট্রেনটির গতিবেগ আপনার কাছে ৬০ কিমি প্রতি ঘন্টাই মনে হবে? না তাহবে না। এখানেই এসে যাচ্ছে আপেক্ষিক গতিবেগের ধারণা। এই ধারণাও খুব সহজ।
আপনি যদি প্রথম ট্রেনটির ভেতর বসে থাকেন তবে প্রাথমিকভাবে অবশ্যই আপনার মনে হবে যে আপনি স্থির বসে আছেন। কিন্তু আপনি স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকলে যখন অন্য ট্রেনটিকে প্রথম ট্রেনটির একই দিকে আসতে দেখবেন তখন আপনার মনে হবে প্রথম ট্রেনের গতি কমে গেছে। সেটি দ্বিতীয় ট্রেনের সাপেক্ষে ২০(৬০-৪০) কিমি/ঘন্টা গতিবেগে দ্বিতীয় ট্রেনকে অতিক্রম করে যাবে। আর যখন দ্বিতীয় ট্রেনটি উল্টোদিক থেকে এসে প্রথম ট্রেনটিকে অতিক্রম করবে তখন আপনার মনে হবে প্রথম ট্রেনটি দ্বিতীয় ট্রেনের সাপেক্ষে অনেক বেশি গতিবেগ ১০০(৬০+৪০) কিমি/ঘন্টা নিয়ে আপনাকে অতিক্রম করে যাবে।
কিন্তু এটা কী করে সম্ভব? ম্যাক্সওয়েল বলেছেন আলোর গতিবেগ সকল মাধ্যম ও পর্যবেক্ষক সাপেক্ষে নির্দিষ্ট। তাই ট্রেনের ক্ষেত্রে যে ঘটনা ঘটেছে সেই ঘটনা মহাবিশ্বে আলোর ক্ষেত্রেও ঘটবে। আইনস্টাইন সবসময় বিশ্বাস করতেন সকল প্রাকৃতিক নিয়মাবলী এই মহাবিশ্বের সকল বস্তুর ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হবে।
তাহলে কোনটি ভুল নিউটনের আপেক্ষিক গতির ধারণা নাকি ম্যাক্সওয়েলের তড়িচ্চুম্বকীয় তত্ত্ব। গতির ধারনার এই প্যারাডক্স আইনস্টাটাইনকে গভীর চিন্তার মধ্যে ডুবিয়ে দিল। বলা হয় আইনস্টাইন এই ধারণাটি তার বাল্যকাল থেকে পোষণ করে এলেও তার মাথায় গভীরভাবে নাড়া দেয় যখন তিনি সুইজারল্যান্ডের বার্ন শহরে এক সামান্য প্যাটন ক্লার্কের কাজ করতেন। একঘেয়ে কাজ তাড়াতাড়ি শেষ করে তিনি যখন ট্রামে চেপে বাড়ি ফিরতেন তখন ট্রামের জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে জাইটগ্লগ ঘড়িটির দিকে রোজ তাকিয়ে তার মনে হত ট্রামটি যদি আলোর গতিতে চলে তবে কি সেই ঘড়িতে একই সময় দেখাবে? নাকি তিনি নিজে ট্রামের ভেতরে বসে থেকে একরকম সময় দেখবেন আর ট্রামের বাইরে যারা আছে তাদের কাছে সময় অন্যরকম দেখাবে?
কতটা মৌলিক কতটা বৈপ্লবিক এই চিন্তা ভেবে দেখুন। একই সাথে সেইসময়ের পরিপ্রেক্ষিতে কতটা ‘অবাস্তব’ কতটা ‘উইয়ার্ড’ শুধু একবার চিন্তা করুন।
(চলবে)
— bemused,enthralled , unputdownable excellent composition! How could you conceive such an IDEA -and dished it in mother tongue ?– shall be waiting eagerly — for next installment — Best Wishes — n.da
Ps : only problem failing eyesight and age related — tiredness seeking relaxation.