- (পূর্ব প্রকাশিতর পরে)
আগেও বলেছি, নাৎসি দর্শনের মধ্যেই কিছু বিষয় ছিল, যা সহজেই আকর্ষণ করতে পেরেছিল ডাক্তারদের। আশেপাশে দেখা অনেক সমস্যার উত্তর খোঁজা হত বায়োলজির মধ্যে – যেমন, অপরাধপ্রবণতা, সমকামিতা ইত্যাদি – সমস্যার মূল লুকিয়ে আছে জিনের মধ্যে, এমনটাই ভাবা হত। আর, জিনের মধ্যেই যদি সমস্যার রহস্য মেলে, তাহলে পূর্ব গৌরবের দিন থেকে জার্মান জাতির অধোগমনের রহস্যও যে লুকিয়ে রয়েছে জিনের অধঃপাতের গভীরে, এ তো আর নতুন করে প্রমাণের প্রয়োজন পড়ে না।
অতএব, এও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া সম্ভব হয়েছিল, যাঁরা যাঁরা তথাকথিত উন্নত জিনের অধিকারী, তাঁদের মধ্যে বংশবৃদ্ধির হার বেশী – এবং সমাজের “অবাঞ্ছিত জঞ্জাল”-দের মধ্যে বংশবৃদ্ধির হার বেশী। এরকম চলতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে আর্য জার্মান মহত্ব যে তলানিতে এসে ঠেকবে, এ তো আর বলার অপেক্ষা থাকে না, তাই না? কিন্তু, চিকিৎসকদের মধ্যে এই ভাবধারা এত দ্রুত জনপ্রিয়তা পেল কী করে?
বিভিন্ন জনজাতির (race) মধ্যে বহিরঙ্গের ফারাক ও তার উদ্ভব নিয়ে ভাবেন নৃতত্ত্ববিদরা (anthropologist)। কিন্তু, তৎকালীন জার্মানিতে যাঁরা নৃতত্ত্ববিদ ছিলেন, তাঁদের অধিকাংশের প্রাথমিক শিক্ষা ছিল চিকিৎসাবিজ্ঞানে। অতএব, একটি জনজাতির সাথে আরেকটি জনজাতির ফারাক – বহিরঙ্গের ফারাক বা আচার-আচরণের ফারাক – সেই ফারাককে সমাজতত্ত্বের দিক থেকে না দেখে শুধুই জিন বা বায়োলজির দিক থেকে বিচার করা সম্ভব হয়েছিল। আর, নাৎসি জার্মানিতে নৃতত্ত্ববিদ্যা ও চিকিৎসাবিজ্ঞানকে পরস্পরের পরিপূরক হিসেবে ভাবার প্রথাই সর্বজনমান্য ছিল। সমস্যার শুরু এখান থেকেই, এবং বাকি অনেককিছুই সেই পথ দিয়ে আরো বেপরোয়াভাবে এগিয়ে চলার পরিণতি।
একটু বেলাইনে গিয়ে মনে করিয়ে দেওয়া যাক, চিকিৎসাবিদ্যাকে শুধুই বিজ্ঞান বা কোনো বিশেষ বিজ্ঞানের এক্সটেনশন হিসেবে দেখতে থাকলে এমন পরিণতি অভাবনীয় নয়। চিকিৎসক যদি তাঁর কর্তব্যকে স্রেফ নির্মোহ বৈজ্ঞানিক কর্তব্য হিসেবে ভাবতে শুরু করেন, তাহলে তিনি বিপজ্জনক অস্ত্রে পরিণত হন – এবং সেই অস্ত্রের অপব্যবহার স্রেফ সময়ের অপেক্ষা। সে বিজ্ঞান হতে পারে জেনেটিক্স – যা দিয়ে প্রমাণ করে ফেলা যায়, যাবতীয় সমস্যার মূলে জিন এবং উন্নত জিনই মানবসভ্যতার ক্রমোন্নয়নের পথ। সে বিজ্ঞান হতে পারে রসায়নবিদ্যা, যা দিয়ে চিকিৎসককে বিশ্বাস করিয়ে ফেলা যায় গবেষণাগারে প্রাপ্ত ফলাফল মানবদেহে হুবহু পুনর্নির্মাণযোগ্য। সে বিজ্ঞান আসতে পারে টেকনোলজির মুখোশে, যা দিয়ে চিকিৎসক ভাবতে পারেন সামনের মানুষটির সমস্যাকে পড়ে ফেলার জন্যে টেকনোলজির বেশী আর কিছুর প্রয়োজন নেই। এবং চিকিৎসককে সামনে ঢাল করে তার আড়ালে ফুলে-ফেঁপে উঠতে থাকে বিবিধ ক্ষমতার মুখ। নাৎসি ডাক্তারের ইতিহাসের পাঠ ও পুনর্পাঠ একারণেই জরুরী, কেননা এ শুধু নৃশংসতার গল্প পড়ে শিউরে ওঠার গল্প নয় – সচেতন না থাকলে, এর পেছনের গল্পের পুনরাবৃত্তি হতে পারে যে কোনো সময়ে – গল্পের শেষে কনসেনট্রেশান ক্যাম্প থাকুক বা না থাকুক, অপচিকিৎসায় বা বিনা চিকিৎসায় বা চিকিৎসার খরচে সর্বস্বান্ত মানুষের হাহাকার রয়েই যায়। তাই, চিকিৎসককে সচেতন হতেই হয়। রাষ্ট্রব্যবস্থার দোহাই ন্যুরেমবার্গ ট্রায়ালেও চিকিৎসকরা দিয়েছিলেন – গ্রাহ্য হয়নি। অন্যায় বা অন্যায্য কাজের শেষে স্বৈরাচারী বা অনাচারী রাষ্ট্রব্যবস্থার দোহাই ইতিহাসের বিচারসভা কিম্বা মানবতার আদালতে গ্রাহ্য হয় না, হতে পারে না। মূল কাহিনীতে ফেরা যাক।
চিকিৎসক ও রোগীর সম্পর্কের মধ্যে একটা ক্ষমতার ব্যবধান থাকে, যেটি অনেকাংশেই তথ্যের অসাম্যের কারণে। আপনার এই এত বছরের জানাচেনা একান্ত আপনারই নিজস্ব শরীরের ভিতরটিতে কী ঘটছে, সেকথা যিনি কয়েক মিনিটে আপনার চেয়ে ভালো করে বুঝে যান, তিনি আপনার চেয়ে ক্ষমতাবান, অন্তত সেই সম্পর্কটি স্থাপনের মুহূর্তে। আপনার আয়ব্যয়ের হিসেব ঠিক কিনা, সেটা চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট আপনার চেয়ে ভালো বোঝেন – কিম্বা, আপনার সম্পত্তির দলিলপত্র সঠিক রয়েছে কিনা, সেটা ভালো বুঝবেন উকিলবাবু – কিন্তু, এর মধ্যে কোনোটিই এই বিশ্বজগতে আপনার প্রাথমিক অস্তিত্বের সাথে জড়িত নয়। এখানেই চিকিৎসকের পেশা বাকি সব থেকে আলাদা – এবং চিকিৎসকের মান্যতা আর পাঁচটা পেশাদারের চাইতে ভিন্ন গোত্রের। এই কথাটা খুব ভালো করে বুঝেছিলেন নাৎসি প্রশাসকেরা।
হিটলারের ব্যক্তিগত চিকিৎসক ছিলেন থিও মোরেল – শুধু ব্যক্তিগত চিকিৎসকই নন, থিও ছিলেন হিটলারের বিশেষ আস্থাভাজন। নাৎসি নেতৃত্বের সাথে ঘনিষ্ঠতার সুবাদে তিনি চিকিৎসক হিসেবে বিশেষ ক্ষমতাবান তো ছিলেনই, সাথে বিভিন্ন প্রকল্পের সুবাদে বেশ টুপাইস কামিয়েও ছিলেন। যদিও থিও মোরেলকে বাকি নাৎসি ডাক্তারদের মতো নৃশংসতার দায়ে অভিযুক্ত করা যায়নি, কিন্তু ক্ষমতার সাথে ঘনিষ্ঠতার সুবাদে তাঁর বক্তব্যের একটা গুরুত্ব তো আলাদাভাবে ছিলই। চিকিৎসকের ভূমিকা নিয়ে নাৎসি পার্টির এক অধিবেশনে থিও মোরেলের বক্তব্যের খানিক অংশ এখানে তুলে দিই –
…যুদ্ধের সময়ই হোক, বা শান্তির সময়, চিকিৎসকের কর্তব্য, যদি সঠিকভাবে পালন করতে হয়, সে হল প্রকৃত অর্থে নেতৃত্বদানের কর্তব্য। চিকিৎসক ও রোগীর মধ্যে যে বিশ্বাসের সম্পর্ক, তা এমনভাবে নির্মিত হওয়া জরুরী, যাতে সবসময়ই এবং যেকোনো মূল্যে চিকিৎসক যেন রোগীর থেকে উচ্চাসনে অধিষ্ঠিত থাকেন। আপনি চিকিৎসক, তার অর্থ রোগী ও চিকিৎসক এই দুই পক্ষের মধ্যে আপনি অধিকতর ক্ষমতাবান।…
অতএব, এই চিন্তাপদ্ধতির ব্যবহারিক প্রয়োগে নাৎসি ব্যবস্থার রেসিয়াল হাইজিন তত্ত্বের মুখ হিসেবে দাঁড় করানো হয়েছিল ডাক্তারদের। সত্যি বলতে কি, কিছু কিছু ক্ষেত্রে, চিকিৎসকের উপর সনাতন ভরসার সম্পর্কটিকে গুছিয়ে কাজে লাগানো গেলে বেশ কিছু অপকর্ম সহজে সারা যায়। কনসেনট্রেশান ক্যাম্পে কাকে দিয়ে কিছুদিন খাটিয়ে নেওয়া যাবে, আর কাদের কাছ থেকে কাজ আদায়ের আশায় নেই, অতএব চটজলদি পাঠিয়ে দিতে হবে গ্যাস চেম্বারে – সেই “সিলেকশন”-এর এক এবং একমাত্র অধিকারী ছিলেন ডাক্তাররা। ১৯৪৩ সালের মার্চ মাসে এই কাজে বিশেষজ্ঞের ভূমিকাটা আরো বিশেষ করে প্রমাণ করতে জারি হয় নতুন নির্দেশিকা – সেইসব চিকিৎসক, যাঁদের নৃতত্ত্ববিদ্যার পাঠ নেওয়া রয়েছে, একমাত্র তাঁরাই ” সিলেকশন”-এর অধিকারী হবেন। এছাড়া বিভিন্ন ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পেশাগত যোগ্যতাকে মানুষ মারার কাজে ব্যবহার করার চল তো ছিলই।
কিন্তু, আবারও মনে করিয়ে দেওয়া যাক, চিকিৎসকরা স্রেফ অসহায় ক্রীড়নক হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছিলেন, এমন নয়। আগেও বলেছি, এইসব অপকর্মে তাঁদের জোর করে টেনে নামানো হয়েছিল বা তাঁদের একাজ করতে বাধ্য করা হয়েছিল, এমন যুক্তি, এমনকি বিচারসভায় সাজার ভয়ের মুহূর্তেও, চিকিৎসকরা দেননি। অসহায়ভাবে ব্যবহৃত হওয়ার কথাও সেভাবে কেউ বলেননি। একদিক থেকে দেখতে গেলে, বা স্রেফ পেশার দিক থেকে ভাবলে, চিকিৎসকরা তো ভালোই ছিলেন।
বিশ্বাস হচ্ছে না? আসুন, দেখে নেওয়া যাক।
ডাক্তারি পেশা থেকে ইহুদি ও কমিউনিস্টদের সম্পূর্ণ ছেঁটে ফেলার পরেও – মনে রাখুন, হিটলার-পূর্ব জার্মানিতে চিকিৎসকদের একটা বড় অংশই ছিলেন ইহুদি – তাঁদের ডাক্তারি পেশা থেকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করার পরেও – নাৎসি জার্মানিতে চিকিৎসকের সংখ্যা নাৎসি-পূর্ব জার্মানির তুলনায় অনেকখানিই বাড়ানো গিয়েছিল।
সম্মানের দিক থেকেও নাৎসি জার্মানিতে ডাক্তারবাবুরা ছিলেন খুবই উচ্চ-আসনে। যেমন ধরুন, সে আমলে জার্মানির বিশ্ববিদ্যালয়গুলির প্রায় অর্ধেকেরই সর্বোচ্চ আসনে (প্রেসিডেন্ট-তুল্য পদ) আসীন ছিলেন চিকিৎসকরা। নাৎসি জমানার আগে বা পরে যে সংখ্যাটা ছিল কুড়ি শতাংশেরও কম।
আয়ের দিক থেকেও ব্যাপারটা তেমনই। নাৎসি আমলের আগে জার্মানিতে ওকালতি পেশার সাথে যুক্ত ছিলেন যাঁরা, তাঁদের গড় আয় ছিল চিকিৎসকদের গড় আয়ের দেড়গুণ। কিন্তু, হিটলারের জার্মানিতে চিকিৎসকের গড় আয় উকিলদের গড় আয়কে ছাপিয়ে যায়।
গবেষণার ক্ষেত্রেও তা-ই। দেশে গবেষণার পরিমাণ আন্দাজ করতে হলে সেদেশ থেকে প্রকাশিত মেডিকেল জার্নালের সংখ্যা থেকে একটা আন্দাজ পাওয়া যেতে পারে (বিশেষত, সেই সময়ে, যখন স্রেফ চাকরি রক্ষার জন্যে পেপার প্রকাশ করার দায় ছিল না সেভাবে)। হিটলার ক্ষমতায় আসার সময়ে স্বল্পসংখ্যক কিছু জার্নালের প্রকাশ বন্ধ হয়ে গেলেও, বেশীর ভাগেরই প্রকাশ নিয়মিত ছিল – অন্তত গোটাতিরিশেক নতুন মেডিকেল জার্নাল সেই সময়েই আত্মপ্রকাশ করে, যাদের মধ্যে অনেকগুলি এখনও নিয়মিতভাবে প্রকাশিত হয়ে চলেছে। এবং, এই যে এত নিয়মিতভাবে প্রকাশিত অ্যাকাডেমিক মেডিকেল জার্নাল, তা যে স্রেফ কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের “চিকিৎসা-গবেষণা”-লব্ধ তথ্যাদি দিয়েই ভরিয়ে তোলা হত না, এ তো সহজেই অনুমেয়।
তাহলে, নাৎসি জার্মানি চিকিৎসকের সংখ্যাল্পতায় ভুগছিল, এমন নয়। এবং সেই আমলে চিকিৎসকরা সম্মান পেতেন যথেষ্ট – আয় করতে পারতেন আগের দিনের তুলনায় ভালোই – চিকিৎসা-পেশার পাশাপাশি যে গবেষণার সুযোগ, সেও ছিল ঠিকঠাক।
তবে কি আমরা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছে যাব, যে, চিকিৎসকরা সুখেই ছিলেন সেসময়?
নাকি, সমাজের বাকি সবার ভালো থাকার সাথে সম্পৃক্ত চিকিৎসকের ভালো থাকা – যে চিকিৎসক আর পাঁচজনের ভালো থাকাকে অগ্রাহ্য করে নিজে ভালো আছি বলে বিশ্বাস করতে পারেন, তিনি চিকিৎসকের ধর্ম থেকেই বিচ্যুত হয়েছিলেন? এবং এই শেষের কথাটুকু যদি মেনেই নেন, আর কথাটা যদি নাৎসি জার্মানির প্রেক্ষিতে সত্য হয়ে থাকে, তাহলে সব দেশে সব কালেই বার্তাটা প্রযোজ্য হওয়া উচিত, তাই না??
(চলবে)
পরবর্তী প্রকাশের অপেক্ষা তে রইলাম।