বাঙালকে হাইকোর্ট দেখানো একটা প্রাচীন বাক্যবন্ধ। প্রাচীন বললাম বটে, কিন্তু সেই অর্থে সুপ্রাচীন কিন্তু নয়। এর শুরু কলকাতায় হাইকোর্ট ছিল? কে জানে।
অরুণাচল খুব ছোটোবেলা থেকেই এই কথাটা নিয়ে ভেবেছে। ভেবেছে মানে, সে যে সেই সময় থেকেই খুব চিন্তাশীল ব্যক্তি ছিল তা’ নয়। বস্তুত কিঞ্চিৎ মেধাহীন ছিল বলেই এই সব ছোটোখাটো ব্যাপারে মাথা খাটানো ছিল তার মানসিক বিলাস।
যেমন সে ভাবত, নিউটনকে কেন গাছ থেকে আপেল পড়া দেখা অবধি অপেক্ষা করতে হয়েছিল। এই চিন্তাটা তার মাথায় প্রথম আসে পাঁচথুপি গ্রামে তাদের ভাড়াবাড়ির খাটা পায়খানায় বসে। খাটা পায়খানা বস্তুটির নাম শুনেই আমার সুসভ্য পরিশীলিত পাঠক পাঠিকা যাঁরা ও বস্তুটি দেখেননি তাঁদের নাকে দুর্গন্ধ আর রুচিতে আঘাত লাগবে। কিন্তু আমি উপায়হীন। সত্য ঈশ্বরের মতনই। এক ও অপরিবর্তনীয়। সেটির পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা অপ্রয়োজনীয় হলেও এটা আমাকে বলতেই হবে, যে পুরীষের ডাব্বাটি অনেক নীচে থাকত, মানে স্কোয়াটিংয়ে সাধনায় বসার জায়গাটি থেকে অনেকই নীচে। বর্জ্যটি নির্গত হয়ে সেখানে পড়ার জন্য যে অনুপলটি লাগত তখনই বালক অরুণাচলের মাথায় এই দার্শনিক কূট প্রশ্নটি জাগে, যে তবে তো নিউটনেরও নিজের প্রাকৃতিক কাজের সময়ই ব্যাপারটি মাথায় আসা উচিত ছিল। তাহলে আর আপেলের মত গোলমেলে ব্যাপার, যাতে কি না ফেঁসে গেছিলেন আদি পিতা ও মাতা অবধি, সেই আপেলের প্যাঁচে তিনি আর জড়াতেন না।
(সংযোজন – নিজের কমেন্ট থেকে, Shyamalendu Sinha
খাটা পায়খানা বিষয়ে আরও একটু বলি তাইলে। বাস্তবেই ব্যবহার করেছি বলেই জানি কী ভাবে ওই ময়লা বর্জ্য আক্ষরিক অর্থেই ভারী পাত্রে তুলে নিয়ে যেতেন কিছু পুরুষ ও নারী। তাঁদের বলা হত ধাঙর। তখনই সেই বাল্যকালে ভেবে পেতাম না তাঁরা পারতেন কী করে। এখন তো আরওই পাই না।
আর একটা কথা, ওই দুর্গন্ধে ভরা কয়েক মিনিটের অবস্থানে আমার সঙ্গে দেখা করতে আসত শালিখ পাখি। আমার সঙ্গে ঠিক নয়। আসত ওই পূরীষভর্তি ডাব্বায় সন্তরণমান অসংখ্য কিলবিলে লার্ভা (সম্ভবত মাছির ম্যাগট) খেতে। কিন্তু বালক অরুণাচল ভাবত, তার সঙ্গেই দেখা করতে আসে। কোনও দিন একজন আসত। কোনও দিন দু’জন। দু’জনে এলে বালক খুশি হত। কিন্তু লজ্জাও পেত খুব। লজ্জা? কেন? বাঃ, ওই দু’জনের মধ্যে একজন মহিলা না? আর অরুণাচল তো তখন পোষাকে একদমই ইয়ে।)
খালি যে বিলেতি প্রহেলিকারর ব্যাপারেই ক্ষুদ্র অরুণাচল ভাবনাচিন্তা করত তাই না। স্বদেশের ব্যাপারেও তার এই জাতীয় অশালীন আগ্রহ ছিল।
যেমন প্রাতঃস্মরণীয় বিদ্যাসাগরের মাতৃভক্তি প্রসঙ্গে দামোদর পেরোনোর চালু গল্পটি নিয়ে।
বিদ্যাসাগর যে প্রকৃতির মানুষ ছিলেন, তিনি নিশ্চয়ই নিজের ঢাক নিজে পেটাননি। জনশূন্য ঝড়ের আবহে নদীতীরে তিনি মাঝিকে ডেকেও পাচ্ছেন না। প্রবল দুর্যোগে দামোদরের দুর্দান্ত স্রোতে ঝাঁপিয়ে পড়লেন, এই নাটকীয় দৃশ্যটির তা’হলে সাক্ষী কে?
তার ভাবনার বিষয়ের অভাব ছিল না। যেমন ধরুন, ন্যাকা চৈতন কথাটির মধ্যে, পরম প্রেমময় চৈতন্যদেবের কোনও বিশেষ আচরণের প্রতি মূঢ় আত্মবিস্মৃত বাঙালির বদমায়েশি ইঙ্গিত আছে কি না, কিম্বা রামবোকা, রামছাগল ইত্যাদি শব্দের মধ্যে রামের মত পৌরাণিক ও ঐশী বীরকে কেন মূঢ় বাঙালিরা যুক্ত করেছিল অশ্রদ্ধেয় শব্দের সঙ্গে, এই সব অমীমাংসিত সমস্যা অরুণাচলকে বড়ই পীড়িত করত।
তালিকা বাড়িয়ে লাভ নেই। হাইকোর্টে ফিরি।
তার পিতামহ, যিনি মিথ্যা যুক্তি সাজানোর দুঃসাহসের অভাবে, ওকালতি পাশ করেও আদালতে যাননি কোনওদিনই, তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিল। “হ্যাঁ দাদু, তুমি তো বাঙাল। তুমি হাইকোর্ট দেখেছ?”
দাদু বললেন, “না দেহি নাই। আমরা তো বাঙাল। আমরার হাইকোর্ট দ্যাহা নিষেধ!”
এ’দিকে আবার ইস্টবেঙ্গল জাগরণী সমিতির স্বনিযুক্ত প্রেসিডেন্ট ব্যাঁকাদা, মানে বরিশালের ব্রজমোহন কলেজের গ্র্যাজুয়েট বঙ্কুবিহারি সরকার বলেছিল, “শুনো তয়, রহস্যখান কই। বাঙালদের অ্যাত্তো কেস ওই হাইকোর্টে হয় যে, আমাগোরে আর হাইকোর্ট চিনাইতে লাগে না।”
এই সব পরস্পর বিরোধী যুক্তি শুনে অরুণাচল হাইকোর্ট বস্তুটাকে প্রবল ভয় পেতো। কিন্তু সেই তাকেই হাইকোর্টে যেতে হয়েছিল।
আজ্ঞে হ্যাঁ। কেন? সাত রাজার ধন এক মাণিক ডিগ্রি সংগ্রহার্থে। প্রসঙ্গত অরুণাচলের মেধার ন্যূনতা নিয়ে তার বা অন্য কারও সন্দেহ ছিল না। সে আমলে ছিল না। এ আমলেও নেই। তাকে এই কারণে সঙ্গত দুচ্ছাই সবাইই করে। মায় কন্যা ও পুত্ররাও।
কিন্তু সে পেশায় আছে, মানে ছিল, সে’খানে বিদ্যে উপার্জিত হোক বা না হোক, নামের পেছনে অক্ষর জুড়বার মহিমা ব্যবহারিক কারণেই অনেক।
অবিশ্যি উনিশশ বিরাশি সালে তার কাছে বিএইচইউতে এমডি পড়ার একটা হাফ চান্স এসেছিল। সেই গল্প সুযোগ পেলে পরে কখনও বলা যাবে। এ’বারের কথা বলি। কলকাতা ইউনিভার্সিটির এমডি এন্ট্র্যান্স তখন আলাদা আলাদা বিষয়ে হত। যেমন জেনারেল মেডিসিন, জেনারেল সার্জারি এবং হরেক বিষয়ে, যে যাতে হাউসস্টাফশিপ করেছে।
অরুণাচলের বিষয় ছিল চেস্ট মেডিসিন। চেস্ট বুঝলেন তো? আজকাল আবার চেস্ট মেডিসিন বলে না। বলে পালমোনোলজি। পালমোনোলজিস্টকে বাংলায় বলে বক্ষরোগ বিশেষজ্ঞ।
মফসসল শহরে এক ক্লাসমেট নাকি, চেম্বারের বাইরের বোর্ডে লিখেছিল, “সকল রকম বক্ষ যত্ন সহকারে পরীক্ষা করা হয়।”
সেই চেস্ট মেডিসিনেরও আলাদা এন্ট্র্যান্স পরীক্ষা।
উনিশশো অষ্টআশিতে পরীক্ষার মাত্রই দিনকতক আগে ইউনিভার্সিটি ডিক্লেয়ার করল, সে বছর চেস্টের পরীক্ষা আলাদা হবে না। জেনারেল মেডিসিনের একই প্রশ্নপত্রে হবে। ঘোর অন্যায়। আমরা শুনেই ভেবেছিলাম এই অন্যায় কোর্টে দাঁড়াবে না।
ব্যাপারটা বলাই বাহুল্য গোলমেলে। কাউকে হয়তো অতিরিক্ত সুযোগ পাইয়ে দেবার জন্য ঘাপলা। এই জন্যেই এ কথা বলছি যে, পরের বছরেই আবার আগের নিয়ম অর্থাৎ চেস্টের আলাদা কোশ্চেন ব্যাপারটা ফিরে এসেছিল।
যাই হোক চেস্ট এমডিতে চান্স পেলাম না। মোটে চারখানা সিট, আমার মেধায় পাবার কথাও না।
মাস কয়েকবাদে খবর পাওয়া গেল, আমাদের ব্যাচমেট এনআরএসের পার্থ হাইকোর্টে কেস করে চান্স পেয়েছে। আমরা যেটা ভেবেছিলাম। হঠাৎ করে পরীক্ষার আগে আগে ইউনিভার্সিটি বলেছে চেস্টের আলাদা পরীক্ষা হবে না। গ্রাউন্ড ওইটেই।
খবর পেয়েই চারজন মক্কেল, মানে আমি দিলীপদা’, সত্য আর প্রতাপ একত্র হয়ে কেস করব ঠিক করলাম। জুনিয়র উকিল বিশ্বনাথদা’ দিলীপদা’র চেনা। তার সঙ্গে গেলাম আরএনমিত্র বলে এক বিখ্যাত লইয়ারের চেম্বারে। তাঁর বাড়িতেই। তিনি শুনে প্রথমেই না করে দিচ্ছিলেন
“আরে, একি হয় নাকি? কে কোথায় কেস করে চান্স পেয়েছে, তাই শুনে তোমরাও!”
হাতে পায়ে ধরে রাজি করানো গেল তাঁকে। পরে বুঝেছি দেরি করে কেস করার সুফল। ওই যে আগেই চান্স পাওয়া পার্থ, সে ভারি গুছোনো ছেলে। ইউনিভার্সিটির এই বছরের প্রথম অ্যাড শুধু নয়, গতবছরের বিজ্ঞপ্তি, এই বছরের বিজ্ঞপ্তি সব জমিয়ে রেখেছিল কেস করবে বলে। সেই কাগজপত্রের কপি, জোগাড় করে কেস করা হল, আমাদেরটাও।
এতদিনে সেই বাঙাল, মানে অরুণাচল হাইকোর্ট দেখল। (এর পরে সেই হাইকোর্ট অধ্যায় আলাদা করে পরের পর্বে বলব। সেই অসামান্য হেনস্থার সব কথা।)
আপাতত আজকের পর্ব আদালতের রায় শুনিয়ে শেষ করি।
প্রসঙ্গত পাঠকদের জানাই জেনারেল মেডিসিনেও অন্য সব সিস্টেম মানে মাথার রোগ, গাঁটের রোগ পেটের রোগের মতনই ওই বক্ষরোগ পড়তে হয়। কাজেই প্রশ্নপত্রেও ওই অন্য রোগের মতনই বক্ষরোগেরও চাট্টি কোশ্চেন থাকে। আক্ষরিক অর্থেও তাইই ছিল।
আমাদের আর এন মিত্র কোর্টকে তাঁর সওয়ালে বলেছিলেন, “জেনারেল মেডিসিনের প্রশ্নপত্রে চেস্টের মানে বক্ষরোগের প্রশ্ন ছিল মাত্রই চারটি।”
অতঃপর আমাদের উকিলের যুক্তি ছিল, “অতএব, সুতরাং, কাজে কাজেই, আমার মক্কেল যদি একশোতে চার পেয়ে থাকে, সে পুরো নম্বরই পেয়েছে ধরে নিতে হবে। কাজেই তাকে ভর্তি করে নেবার নির্দেশ দেওয়া হোক।”
মহামান্য আদালতে এই যুক্তি গ্রাহ্য হয়েছিল।