চোখের সামনে সময়ের দাম কমে গেল। ইয়ে, সময়ের ঠিক না। সময়-ধারকের, মানে ঘড়ির। এক জীবনে কতই দেখলাম।
ছিনতাই, ওয়াগন ব্রেকিং, সিনেমার টিকিট ব্ল্যাক এইসব রোমাঞ্চকর পেশার মধ্যে এখন শুধুমাত্র ছিনতাইটাই টিঁকে আছে।
সেই ছিনতাইয়ের একটা প্রধান আইটেম ছিল ঘড়ি। চাকু বা পিস্তল বার করে, হিসহিসে গলায়,- দেখি ঘড়ি পার্স গয়নাগাঁটি কী আছে?
এই অমোঘ জিজ্ঞাসার ভেতর থেকে ঘড়ি বস্তুটা কেমন যেন উধাও হয়ে গেল। অথচ বছর তিরিশ চল্লিশ আগে অবধি ঘড়ি বস্তুটা ছিনতাইবাজদের কাছে রীতিমত মহার্ঘ ছিল।
তার পরে এল ডিজিট্যাল ঘড়ি। অতীব সস্তায়, নব্বইয়ের দশকে বাজার প্লাবিত করেছিল সংখ্যায় সময় দেখানো মেশিন। মাত্রই পনেরো কুড়ি টাকায় সেই সব ঘড়ি বিক্রি হত ফুটপাথে বা অন্যান্য অনভিজাত জায়গায়। তার আবার কত রকমফের।
অশেষের ভাইপোকে একটা কিনে দেওয়া হয়েছিল ক্লাস সেভেনে। তার অ্যলার্মে ছিল মুর্গির ডাক। ভূগোল ক্লাসে সেই মুরগি তারস্বরে ডেকে উঠেছিল যান্ত্রিক ত্রুটিতে। ছেলের সারা গা মেরে লাল ছোপছোপ করে দিয়েছিল পাষণ্ড ভূগোল স্যার। পুলিশকেস হওয়া উচিত ছিল।
থাক, সে অন্য গল্প।
অশেষের ঘড়ির গল্প বলি।
এখনের দিনে সেই সেন্টিমেন্ট বোঝা মুশকিল। মোবাইল ফোন এসে অবধি ঘড়ি মানে হাত ঘড়ির মর্যাদা একেবারে গেছে।
প্রথম হাতঘড়ি জুটল হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করে। তার আগে অবধি বাড়ির গুরুজনদের কারোর ঘড়ি কব্জিতে গলিয়ে পরীক্ষা দিতে যাওয়া। হায়ার সেকেন্ডারির মার্কশিট দেখাতেই ধনকাকু নিজের হাত থেকে খুলে রিস্ট ওয়াচটা অশেষের হাতে পরিয়ে দিতেই এক লাফে অশেষ যেন বড় হয়ে গেল অনেকখানি।
এইচএমটি কোম্পানির জনতা ঘড়ি।
আজকের গল্পের নায়ক অশেষ নয়। নায়ক অশেষের সাধের সেই ঘড়িটি।
সহ নায়ক? হ্যাঁ, তাও আছে বইকি! সে আসবে কাহিনির শেষদিকে।
একতলা ভাড়াবাড়ি। সবে মাঝরাত পেরিয়েছে। টেবিলে ঘড়ি খুলে রেখেছিল রাত্তিরে শোবার আগে। হঠাৎ সরসর আওয়াজে ঘুম ভেঙে যেতেই অশেষ দেখল একটা হাত খোলা জানলা গলে ভেতরে এসে টেবিল হাটকাচ্ছে। চটকা ভাঙতে না ভাঙতেই সেই হাতটা টেবিলে রাখা ঘড়ির নাগাল পেয়ে গেল।
এমনিতে স্বভাবকুঁড়ে। নড়ে বসতে বছর কেটে যায়। কিন্তু সাধের ঘড়ি চুরি যাচ্ছে এই বোধটা মাথায় খেলতেই হইহই করে উঠে পড়ল অশেষ।
– চোর চোর …
আওয়াজ তুলে দরজার ছিটকিনি খুলে বার হবার আগেই ধুপধাপ আওয়াজ করে পাঁচিল টপকে চোর বাবাজি হাওয়া।
তিন বেচারি টর্চের ফোকাসের অনেক দূরে সেই চোর। বারোয়ারি তলার মোড়ের মাথায় কুকুরেরা বৃথাই ঘেউ ঘেউ করে সোরগোল করছে তখন।
নাগাল পাবে না জেনেও তবু বেচারা অশেষ মিছেই দৌড়ে গেল বারোয়ারি তলা অবধি। চেনা কুকুরেরা লেজ দুলিয়ে সমস্বরে হ্যা হ্যা করতে করতে জানাল চোর ভাগলবা।
হৃতধন পুনরুদ্ধারে ব্যর্থমনোরথ কলেজ পড়ুয়া বাড়ি ফিরে উঠোনে কিছু একটা দেখতে পেল। টর্চের আলোয় চকচক করছে। কাছে গিয়ে তাকে দেখা গেল।
সে বস্তুটিই এই কাহিনির সহনায়ক। সিঁদকাঠি। দেখেই বোঝা যায় সদ্য বানানো। খাঁটি ইস্পাতের।
শিক্ষানবিশ চোর ঘড়ি পাবার উত্তেজনায় তার প্রফেশনাল হাতিয়ার ফেলে উধাও হয়েছে।
অশেষ বহুদিন আশায় আশায় ছিল। যদি চোর ফিরে আসে সিঁদকাঠির খোঁজে। সে এমনকি কিছু মূল্যও ধরে দিতে রাজি ছিল সেই হারাধনের জন্য। না, আসেনি।
পরোপকারী অশেষ তারপরে সেই সিঁদকাঠি দান করারও চেষ্টা করেছে, এলাকার প্রসপেকটিভ চোরদের কাছে। ঘড়ি গেছে যাক। কাজের জিনিস ফেলে রেখে কাজ নেই।
নাঃ, কেউই রাজি হয়নি। এলাকায় সব বাড়িই পাকা গাঁথনির। সিঁদকাঠি দিয়ে দেওয়ালে গর্ত খুঁড়ে ঢোকার সেই শিল্প অচল। তেমন শিল্পী আজ আর কেউ নেই।
অশেষ ভাড়াবাড়ি ছেড়ে নিজের বাড়িতে উঠে এসেছে বহুদিন। তার ড্রয়িং রুমের দেওয়ালে ভ্যান গগ যামিনী রায়ের বাঁধানো কপির পাশে ঝুলছে সেই এক অধুনা বিলুপ্ত শিল্প সামগ্রী।
চোরের ওপর বাটপারি করে পাওয়া সিঁদকাঠি।