ভারত ও কানাডার আকস্মিক কূটনৈতিক দ্বন্দ্ব এবং ভারত সরকারের কিছু কড়া পদক্ষেপের আবহে প্রবল অনিশ্চয়তা ও টেনশনের মধ্যে কানাডা যাত্রা। ইউক্রেন যুদ্ধ চলছিলই, হঠাৎ করে শুরু হল হামাস – ইজরায়েল ভয়ঙ্কর যুদ্ধ। মধ্যপ্রাচ্য সহ সমস্ত বিশ্ব থমথমে। তবে কলকাতা থেকে শেষ রাতের কাতার এয়ারওয়েজের বিমান পাঁচ ঘণ্টা ৪০ মিনিটে দোহা, তারপর কয়েক ঘণ্টা বিরতি দিয়ে, পশ্চিম এশিয়া – কৃষ্ণসাগর – ইউরোপ – আর্কটিক রুটে ১৩ ঘণ্টা ৩৫ মিনিটে মন্ট্রিয়ালের ইউল-পিয়ের ট্রুডো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ঠিকঠাক পৌঁছে দিল।
মুক্ত পরিবেশ : সেন্ট লরেন্স নদীর তীরে কানাডার ফরাসী ভাষী বৃহত্তম প্রদেশ কুবেকের রাজধানী ছবির মত সুন্দর শহর মন্ট্রিয়ালে এসে সম্পূর্ণ চাপ মুক্ত হলাম। বিশ্বজুড়ে যে এত অশান্তি চলছে সেদিন থেকে কানাডা ছাড়া অবধি একবারও মনে হয়নি। মানুষজন দিব্যি তাদের কাজকর্ম নিয়ে আনন্দে ও শান্তিতে রয়েছেন। তার উপর হোয়াইট খ্রীস্টমাস (বরফাবৃত) আসছে তাই সর্বত্র এক উৎসবমুখর পরিবেশ। আরও আশ্চর্যের বিষয় কানাডিয়ানদের একটি বড় অংশই অভিবাসী। নিজদেশে তারা কেউ কেউ পারস্পরিক সঙ্খর্ষে লিপ্ত, অথচ এখানে মিলেমিশে আছেন। ইওরোপ ও এশিয়ার দেশগুলিতে এখন নানারকম কড়াকড়ি। কয়েকবছর আগে দক্ষিণ আমেরিকার ব্রাজিলে গিয়ে যে মুক্ত বাতাবরণ পেয়েছিলাম সেটাই যেন ফিরে পেলাম উত্তর আমেরিকার কানাডায় এসে। মুক্ত নাগরিক জীবন নিয়ে যে যার কাজ সুশৃঙ্খলভাবে করে চলেছেন। বেশিরভাগ ব্যবস্থাই যান্ত্রিক। একটি মেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে ইন এবং আউট-এমিগ্রেশনের জন্য এক মিনিটের অটো চেকিং। পুলিশ ও নিরাপত্তারক্ষীর সংখ্যা খুব কম। বিমানবন্দরের কর্মচারী থেকে ক্যাব ড্রাইভার থেকে রেস্তোরাঁ কর্মী বেশির ভাগই আরব, লেবানেজ, তুর্কী, কৃষ্ণাঙ্গ, মেক্সিকান ইত্যাদি। কিছু ভারতীয়, পাকিস্তানী ও বাংলাদেশী আছেন। ভারতীয়দের মধ্যে গুজরাতি ও পাঞ্জাবী বেশি। বাকি অন্যান্য প্রদেশের। পাঞ্জাবী শিখরা বেশি রয়েছেন পশ্চিমের ব্রিটিশ কলম্বিয়া ও আলবার্টা প্রদেশে এবং টোরোন্টোর ব্র্যামটন শহরতলিতে। পূর্বের মন্ট্রিয়ালের পাট চুকিয়ে আমরা এবার এয়ার কানাডায় চললাম দক্ষিণে বিশ্ববিখ্যাত পঞ্চহ্রদের মধ্যে অন্টারিও, ইরি, হুরণ ও সুপিরিয়র চারটিকে ধারণ করা দ্বিতীয় বৃহত্তম প্রদেশ অন্টারিওর টোরোন্টো শহরের পিয়ারসন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের উদ্দেশ্যে।
বহুজাতিক : কানাডাকে বলা হয় বিশ্বের মধ্যে সবচাইতে জাতিগত ও সংস্কৃতিগত বৈচিত্র্যময় দেশ। রাশিয়ার পর বিশ্বের এই দ্বিতীয় বৃহত্তম বিশাল দেশটির আয়তন ৯৯ লক্ষ ৮৫ হাজার বর্গ কি.মি. হলেও লোক সংখ্যা মাত্র চার কোটি। জনঘনত্ব প্রতি বর্গ কি.মি.তে মাত্র ৪.২ জন। দেশের তুষারময় সুবিস্তৃত উত্তর অংশ এবং প্রেইরিময় বিশাল মধ্যাংশ প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর ও নিসর্গ সৌন্দর্যে অপরূপ হলেও শীতল আবহাওয়ার জন্য জনবিরল। দেশের অর্ধেক জনসংখ্যাই থাকেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সংলগ্ন অন্টারিওর দক্ষিণে হ্রদবেষ্টিত অঞ্চলের টোরোন্টো, লণ্ডন, উইনজা, কিচুনা প্রভৃতি শহরে। এছাড়াও অটোয়া, মনট্রিয়াল, ভ্যাঙ্কুভা, এডমানটন প্রভৃতি অন্য প্রদেশের বড় শহরগুলিতে।
জনবিরলতার কারণেই কানাডাকে অভিবাসীদের বরণ করে নিতে হয়েছে। বর্তমান জনসংখ্যার ৫৩% পূর্ব ইওরোপীয়, তুর্কী সহ ইওরোপের অভিবাসী। ১৪% নর্থ আমেরিকান যাদেরও পূর্বপুরুষ ইওরোপ থেকে আগত। জনসংখ্যার ৬৭% শ্বেতাঙ্গ। এরপর সংখ্যা ভারী এশিয়দের (১৯%)। তাদের মধ্যে চীনারা (৪.৭%) খুবই প্রতিষ্ঠিত। টোরোন্টোর বর্তমান মেয়র একজন চীনা মহিলা। ভারতীয় প্রায় ৪.৪% যাদের মধ্যে ২.১.% পাঞ্জাবী শিখ। বাকিরা পাঞ্জাবী হিন্দু, গুজরাতি, মারাঠী, বাঙালী, দক্ষিণ ভারতীয় ইত্যাদি। পাকিস্তানী ৩.৮১%, আরব ও পশ্চিম এশিয় ৩%। পররাষ্ট্র নীতি অনুযায়ী কানাডা বেশ কিছু আফগান, সিরিয়ান, কুর্দ ও প্যালেস্তানিয়ান উদ্বাস্তুকে আশ্রয় দিয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশী, নেপালী, ফিলিপিনো, কোরিয়ান, ইরানি প্রমুখরা রয়েছেন। জনসংখ্যার মধ্যে ইনুইট সহ নিজস্ব জনজাতির সংখ্যা ৫%, আফ্রিকান ৪%, লাতিন আমেরিকান ৩%, ক্যারিবিয়ান ২%। ধর্মের দিক থেকে খ্রিস্টান ৫৩%, নিরীশ্বরবাদী ৩৫%, মুসলমান ৬%, হিন্দু ২%, শিখ ২%। জনজাতি, ইহুদি, বৌদ্ধ, অন্যান্য ধর্মাবলম্বী মিলিয়ে ২%।
প্রাচুর্যময় উন্নত দেশ : প্রকৃতি কানাডাকে উজাড় করে দিয়েছে। এই বিশাল দেশের ৩৯% অরণ্য এবং ১১% মিষ্টি জলের হ্রদ। অসংখ্য ছোট হ্রদ ছাড়াও রয়েছে ৫০টি বড় হ্রদ (>১,০০০ বর্গ কি.মি.)। প্রশান্ত মহাসাগর এবং অতলান্তিক, আর্কটিক, বাফিন, হাডসন, ল্যব্রাডর সাগর ও উপসাগর মিলিয়ে দুনিয়ার দীর্ঘতম সমুদ্রতট (২,৪৩,০৪২ কি.মি.) দিয়ে চলেছে অঢেল সামুদ্রিক সম্পদ। কানাডিয়ান প্রেইরি এবং সেন্ট লরেন্স অববাহিকা মিলে বিশ্বের সর্ববৃহৎ কৃষি ক্ষেত্র। প্রচুর পরিমাণে গম, তৈলবীজ, আলু, ভুট্টা, ডাল, ওট, সবজি, ফল উৎপন্ন হয়। কানাডা বিশ্বের বৃহত্তম কৃষি রপ্তানিরও দেশ। এছাড়াও মৎস্য, পশুপালন, দুগ্ধ, পোল্ট্রি, হরটিকালচার প্রভৃতি শিল্পও উন্নত। কৃষি ও অন্যান্য ক্ষেত্র যন্ত্রচালিত ও আধুনিক। সারা দেশ জুড়ে উন্নত বিমান, ট্রেন ও সড়ক পরিবহন ছাড়াও পূবে অতলান্তিক সাগর থেকে পণ্যবাহী জাহাজ নদী, হ্রদ ও খাল পথে অনেকটা ভিতরে লেক সুপিরিয়র অবধি বন্দরগুলিতে পৌঁছে যায়।
পেট্রোলিয়াম শিল্পও উন্নত। বিশ্বের খনিজ তেল ভাণ্ডারের ১৩% রয়েছে কানাডায়। এছাড়াও পর্যাপ্ত পরিমাণে রয়েছে লোহা, কয়লা, অ্যালুমিনিয়াম, জিঙ্ক, সোনা, ইউরেনিয়াম, লিথিয়াম, ক্যাডমিয়াম প্রভৃতি প্রয়োজনীয় ধাতু। রাস্তাঘাট, সেতু, ব্রিজ, বিমান বন্দর, জাহাজ বন্দর, মেট্রো, বিদ্যুৎ, পানীয় জল, পয়ঃপ্রণালী, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, গণপরিবহন, হোটেল, পার্ক, স্টেডিয়াম—সব মিলিয়ে পরিকাঠামো ও পরিষেবায় উন্নত। অটোমোবাইল ও অ্যারোনটিকস সহ বিভিন্ন শিল্পে এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে বিশেষত মহাকাশ ও পরমাণু গবেষণায় এগিয়ে। এগিয়ে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যেও। টোরোন্টোর স্টক এক্সচেঞ্জ বিশ্বের নবম বৃহৎ। মিশ্র বাজার অর্থনীতির কল্যাণে কানাডার অর্থনীতি : জিডিপি (নমিনাল) মোট ২,১১৮ ট্রিলিয়ন ডলার (বিশ্বের মধ্যে ১০ তম স্থান) ও জনপ্রতি বার্ষিক আয় ৫৯,৮১৩ ডলার (বিশ্বে ১৮তম)। জীবন যাপনের মান খুবই উন্নত: হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট ইনডেক্স (এইচ.ডি.আই) ০.৯৩৬ (বিশ্বে ১৫ তম)। বিশ্বের ১৪তম দূর্নীতিমুক্ত দেশ : কোরাপশন পারসেপশন ইনডেক্স (সি.পি.আই) ৭৪। এক কানাডিয়ান ডলার ৬৩ ভারতীয় রুপির সমান।
শাসন ব্যবস্থা : বাহ্যিকভাবে কমনওয়েলথে এবং নামমাত্র ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের অধীনে থাকলেও কানাডা স্বাধীন, যুক্তরাষ্ট্রীয়, সাংবিধানিক গণতান্ত্রিক দেশ যেখানে নারী, জনজাতি, অধিবাসী, এল.জি.বি.টি.কিউ+সহ প্রতিটি নাগরিকের অধিকার, ন্যায়বিচার, সমাজকল্যাণ, সামাজিক সহায়তা ও সমাজতান্ত্রিক বিষয়গুলির উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। সমগ্র বাজেটের ২১% পরিকাঠামো রক্ষণবেক্ষণে, ১২.২% স্বাস্থ্যে, ১১.৪% শিক্ষায় এবং মাত্র ১.৩% প্রতিরক্ষায় ব্যয় হয়। দশটি প্রদেশ (Provinces), তিনটি অঞ্চল (Territories) এবং জনজাতি ফার্স্ট নেশন (৬৩০) ও রিজার্ভগুলির (৩৩৯৪) কিছু নিজস্ব নিয়মকানুন ও স্বায়ত্বশাসন আছে। প্রতিটি নাগরিকের রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্য বীমা রয়েছে যার খরচ করের থেকে সংগ্রহ করা হয়। গভর্ণর জেনারেল সর্বোচ্চ পদ হলেও প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীসভার হাতে শাসন ক্ষমতা। বর্তমান গভর্ণর জেনারেল একজন জনজাতি নারী। মারী সিমন। নির্বাচনের মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলি ক্ষমতায় আসে। লিবারেল পার্টি ও কনজারভেটিভ পার্টি দুটি প্রধান দল।
এত বড় দেশ, এত সুন্দর জায়গা, দেখে শেষ করা যায় না। কম সময়ের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ সিদ্ধান্ত নেওয়াও সম্ভব নয়। তবু চোখ কান খোলা রেখে, এদিক ওদিক বেশ কিছু জায়গা ঘুরে, বিভিন্ন ধরনের মানুষের সাথে কথা বলে কিছুটাতো বোঝা যায়। পুলিশ প্রায় চোখেই পড়েনি। দু এক জায়গায় দেখেছি। সঙ্গে কোন অস্ত্র দেখিনি। একটি তদন্তে একজন পুলিশ অফিসার এসেছিলেন। আগে ফোনে জানিয়ে একদম ঠিকসময়ে এসেছিলেন। প্রায় সাড়ে ছ ফুট সুদর্শন ঐ নরদানব নিজের পরিচয় দিলেন ইউসুফ। পরে জেনেছিলাম তুর্কী বংশোদ্ভুত। প্রথমে করমর্দন করে ” সারাদিন কেমন কাটল? কোন অসুবিধা হচ্ছে কিনা? ” ইত্যাদি জিজ্ঞাসা করে দ্রুত তদন্ত সারলেন। এরপর ১৬ কি.মি. দূরে অকুস্থলে তদন্ত সম্পূর্ণ করে ফোনে তৎক্ষণাৎ জানিয়ে দিলেন এবং বিষয়টি মিটিয়েও দিলেন। আমাদের দেশে যাদের পুলিশের অভিজ্ঞতা আতঙ্ক, অত্যাচার, উৎকোচ, অসহযোগিতা, দুর্ব্যবহার ও হয়রানি নিয়ে তাদের কাছে অভাবনীয়। একদিন এক প্লাম্বার এসেছিলেন নিজস্ব দামী মার্সিডিজ বাসে চেপে।পূর্ব ইউরোপের আভিবাসী। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা অনেকেই হোটেল, রেস্তোরাঁ, মল, শপিং কমপ্লেক্স, ক্যাব চালনা প্রভৃতির কাজ করেন। কানাডায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মত বন্দুক সংস্কৃতি ও জাতি বিদ্বেষ নেই। কাজের সুবিধার্থে কানাডায় ছয়টি টাইম জোন, যেগুলিতে আবার ঋতু পরিবর্তনের সাথে সাথে টাইম অ্যাডজাস্টেড হয়।
প্রকৃতি ও পরিবেশ : একদিকে সবুজ ও শূন্য বিকিরণ নীতি, অন্যদিকে বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রভাব সহ শিল্প, পরিবহন, খনি, দাবানল প্রভৃতি দূষণের চ্যালেঞ্জের মধ্যেও যেটুকু যা দেখেছি কানাডার আকাশ ও বাতাস অনেক নির্মল, নদী ও হ্রদের জল স্বচ্ছ, পানীয় জল জীবাণুমুক্ত, রেস্তোরাঁ-হোটেলের খাবার স্বাস্থ্যকর। পয়ঃপ্রণালী উন্নত। প্রতিটি গৃহ থেকে তিন ধরনের বর্জ্য নিয়ে যাওয়ার সুবন্দোবস্ত আছে। প্রতিটি কাউন্টিতে নির্দিষ্ট পরিমাণ অরণ্য রয়েছে। শহরে রয়েছে প্রচুর গাছগাছালি ও পার্ক এবং পর্যাপ্ত ফুটপাথ ও সাইকেল ট্র্যাক। আছে ট্রাম ও ফেরি সার্ভিস।
নাগরিকেরা : দেখে অবাক লাগে আমরা ভারতীয়রা দেশের মাটিতে নিয়মের তোয়াক্কা করি না। অথচ এখানে অন্য সবার মত নিয়ম ও সহবৎ মেনে চলছি। গ্রামের রাস্তাই হোক বা শহরের রাস্তাই হোক বা হাইওয়ে রাস্তাঘাট চওড়া, পরিস্কার ও মসৃণ। পরিস্কার সাইনেজ এবং সিগন্যালিং। বড় বড় ট্রাক, ভালো কণ্ডিশন। নিয়মমত যে যার লেনে দ্রুত ছুটে চলেছে। নিয়ম ভাঙলে পুলিশ কড়া পদক্ষেপ করে। রাস্তার ডানদিক দিয়ে গাড়ি চলে। পথচারীদের নির্দিষ্ট ইন্টারসেকশনে জেবরা ক্রসিং দিয়ে যাবার আগে ল্যাম্পপোষ্টে লাগানো বোতাম টিপতে হয়। কিছুক্ষণ পর রাস্তা পারাপারের সিগন্যাল দেখায়। তখন গাড়ি চলাচল বন্ধ থাকে। অ্যাম্বুলেন্স বা পুলিশের গাড়ি হুটার বাজিয়ে গেলে সমস্ত গাড়িকে থামিয়ে রাস্তার সাইডে সরে পথ করে দিতে হয়। হলুদ রঙের ও চিহ্ন দেওয়া স্কুল বাস চলার সময় অন্য গাড়িদের অনেকটা দূরত্ব রেখে যেতে হয়। স্কুল বাস বাচ্চাদের নামানো ওঠানোর জন্যে কোথাও দাঁড়ালে দুদিকের গাড়িদের দাঁড়িয়ে যেতে হয়। প্রত্যেকের নিজস্ব গাড়ি ছাড়াও ক্যাব ও ট্যাক্সি সার্ভিস আছে। আছে চমৎকার ও আরামদায়ক বাস ও ট্রেন সার্ভিস। বড় শহরগুলিতে রয়েছে একাধিক করে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। ছোট শহর ও কাউণ্টিগুলিতেও রয়েছে ছোট ছোট বিমানবন্দর। দোকানে, পেট্রল পাম্পে জিনিস সংগ্রহ করে কার্ড ছুঁয়ে দাম মেটানো সবকিছুই করতে হয় নিজেকে।
প্রতিটি অঞ্চলে একটি নির্দিষ্ট এলাকায় রয়েছে প্রয়োজনীয় ও আধুনিক ডিপার্টমেন্টাল ষ্টোর – শপিং মল – রেস্তরাঁ -সার্ভিস সেন্টার ইত্যাদি। হাইওয়েতে ৫০ কি.মি. পরপর পেট্রল পাম্প, শৌচাগার, কফি শপ, রেস্তরা, বিশ্রামাগার, থাকার ব্যাবস্থাসম্পন্ন ‘অন রুট’ রয়েছে। সমস্ত গুরত্বপূর্ণ স্থানে পরিচ্ছন্ন শৌচাগার ও ময়লা ফেলার জায়গা রয়েছে। দুর্গম বেড়ানোর জায়গাগুলিতেও রয়েছে বায়োটয়লেট ও গার্বেজ বিন। আর দেশের সর্বত্র রয়েছে জনপ্রিয় ‘টিম হরটন্স’ বহুজাতিক কফি হাউস ও রেস্তরাঁ চেন। সবকিছু সাজানো গোছানো এবং পরিস্কার। কানাডায় আরেকটি বিষয় ভালো লাগল সেটি হল কোন কিছুতে বাহুল্য নেই। ফলে সদ্য ঝরে যাওয়া মেপল ও অন্যান্য গাছের পাতা দেখতাম গৃহের বাগান ও সামনের রাস্তা থেকে বৃদ্ধ বৃদ্ধা সমেত নাগরিকরা নিজেরাই পরিস্কার করে নির্দিষ্ট ব্যাগে ভরে পৌরসভার বর্জ্য নেওয়ার গাড়ির জন্য নির্দিষ্ট জায়গায় রেখে দিচ্ছেন। প্রতিটি গৃহে সেন্ট্রালাইজড টেম্পারেচার রেগুলেটর সিস্টেম এবং ঠাণ্ডা ও গরম জলের ব্যবস্থা। গৃহসংলগ্ন আণ্ডারগ্রাউণ্ড হাইড্রেন্ট আছে অগ্নিনির্বাপনের সহায়তার জন্য। আপৎকালীন ৯১১ ডায়াল করলেই দ্রুত পুলিশ এসে উপস্থিত হয়।
টোরোন্টোর ডাউনটাউনের কেন্দ্রস্থলে একটি প্রশস্থ জায়গায় দেখি হিপ্পিরা গানবাজনা করছেন, তিব্বতী উদ্বাস্তুরা তাদের সমস্যা ফেস্টুনে লিখে নির্বাক প্রতিবাদ জানাচ্ছেন। ইসলামের প্রচারকরা কোরান বিতরণ করছেন। অদূরে একটি মঞ্চকে ঘিরে ভারতীয়দের পোষ্ট-দেওয়ালি মেলা এবং নাচা-গানার অনুষ্ঠান চলছে। চার পাশে ছড়িয়ে বিভিন্ন দেশের পর্যটক। দুজন মাত্র পুলিশ সাইকেলে এসে চুপচাপ একপাশে দাঁড়িয়ে আছেন। আরেকদিন সেখানেই প্যালেস্টাইনের স্বাধীনতার দাবীতে একটি বড় মিছিল এল। কিন্তু শান্তিপূর্ণ। বহুতল ইউনিয়ন রেল স্টেশনটি দেখার মত। ভায়া রেল, গো রেল এবং মেট্রোকে সংযুক্ত করেছে। মনে হয় বিমানবন্দর এবং শপিং মলের মিশেল। পর্যটকদের ভিড় বেশি গগনচুম্বী ‘সি এন টাওয়ার’ এবং প্রকৃতির বিস্ময় নায়াগারা ফলসের কাছে। ‘রিপ্লি অ্যাকোরিয়াম’টি অসাধারণ। হ্রদগুলির চমৎকার সৈকতগুলিতে এবং মনোরম দ্বীপগুলিতেও পর্যটকদের আনাগোনা। আর যারা একসপিডিশনে আগ্রহী তারা উত্তরের দিকে পা বাড়ান।
ভালোবাসার দেশ : কোভিড অতিমারি জীবনকে সাময়িক থমকে দিয়েছিল। ইউক্রেন যুদ্ধ অর্থনীতিতে এবং গাজার যুদ্ধ পররাষ্ট্র নীতিতে প্রভাব ফেলেছে। জীবনযাত্রার খরচ অনেক বেড়ে গেছে। দেশের মধ্যে প্রাচুর্যের অঙ্গ হিসাবে এবং বহুরকম রাষ্ট্রীয় খয়রাতি পাওয়া শ্বেতাঙ্গদের একটি অংশ কোনরকম কাজ না করে বসে খাওয়া ও তাদের কেউ কেউ মাদকের নেশায় ঝুঁকছেন। তাদেরই একটি অংশ গৃহহীন হয়ে পার্ক, বাস ষ্টপ ইত্যাদি দখল করে থাকছেন। কেউ কেউ ছোটখাটো অপরাধে অংশ নিচ্ছেন। এই সামাজিক সমস্যাটি ছাড়া তেমন বড় কোন সমস্যা চোখে পড়েনি। শিখ অধ্যুষিত কয়েকটি পকেটে খালিস্তানী প্রচার আগে থেকেই ছিল, তা নিয়ে রাজনীতিও ছিল। কিন্তু একটি ঘটনা নিয়ে দু দেশের দীর্ঘ সুসম্পর্কের যে অবনতি ঘটল এবং কূটনৈতিক দৌত্য ছাপিয়ে আধিকারিকরা যেভাবে বিবৃতি-পাল্টা বিবৃতি দিলেন তা দুঃখজনক। যদিও ভারতীয় মেডিয়া পল্লবিত করলেও কানাডার সমাজ জীবনে এর কোন প্রভাব চোখে পড়েনি।
এত বড় দেশ সমস্যাতো কিছু থাকবেই। প্রধান সমস্যাটি আমাদের দেশের ঠিক বিপরীত। কাজের মানুষের অভাব। যতই যন্ত্রচালিত আধুনিক ব্যবস্থা হোক পরিচালনায় মানুষের প্রয়োজন। তাই অভিভাসন কানাডায় স্বাগত। শুধু স্বাগত বললেই হয় না। অভিবাসীদের ভালোবেসে, কাছে টেনে, নিজের মত করে গড়ে পিঠে নিয়ে, নাগরিক অধিকার দিতে হয়। কানাডা সেটি করতে পেরেছে। অভিবাসীরা স্থানীয়দের সাথে মিলে সুন্দরভাবে দেশ চালাচ্ছেন। অন্যদিকে আমরা ব্রিটিশ প্ররোচনায় হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা করে দেশটিকে তিন টুকরো করলাম। উদ্বাস্তুদের মানবেতর জীবনের দিকে ঠেলে দিলাম। চীনা, অ্যাঙ্গলো-ইণ্ডিয়ানদের দেশ থেকে তাড়ালাম। তারপর শিখদের তাড়াতে শুরু করলাম। তাড়াতে শুরু করলাম অসমের বাঙালী ও মণিপুরের কুকিদের। এখন আবার সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ জাগিয়ে হিন্দু রাষ্ট্র গড়তে চলেছি যেখানে মুসলমান, খ্রীস্টান, বৌদ্ধ, শিখ, পার্শি সবাই শঙ্কিত। ধনী, উন্নত ও আধুনিক কানাডা সেদিক থেকে উদার ও মুক্ত। তাই সেটি শুধু সৌন্দর্য ও প্রাচুর্যেরই দেশ নয়, ভালোবাসা ও শান্তিরও দেশ।