ব্রিটিশ রেডক্রস সোসাইটি-র রিপোর্ট (৭ ডিসেম্বর, ২০২৩) অনুযায়ী, আফ্রিকার ১৫ কোটি মানুষ ক্ষুধার্ত। ইউক্রেন-রাশিয়ার দীর্ঘকালীন যুদ্ধের ফলশ্রুতিতে আমদানি করা জ্বালানি তেলের দাম আকাশ ছুঁয়েছে। সারের জোগান ভীষণভাবে হ্রাস পেয়েছে। যুদ্ধে অস্ত্র জোগানোর জন্য ইউরোপীয় দেশগুলি থেকে যে আর্থিক সাহায্য আসত, তা বিপুল পরিমাণে কমে গেছে। সহজবোধ্য যে আফ্রিকার মানুষের মুখে খাদ্য তুলে দেবার পরিবর্তে যুদ্ধাস্ত্র বিক্রি করলে মুনাফা অনেক বেশি। “আমরা তো এতেই খুশি; বলো আর অধিক কে চায়?” যুদ্ধ এবং ক্ষুধার মধ্যে কর্পোরেট-শাসিত রাষ্ট্র বেছে নেয় যুদ্ধকে। আফ্রিকার মোট ২০টি দেশে এই বুভুক্ষা এবং খাদ্যসুরক্ষার অভাব সর্বব্যাপী। কিন্তু এদের মধ্যেও কেনিয়া, নাইজেরিয়া, ইথিওপিয়া এবং সোমালিয়া সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছে। বলার কথা, পরিবেশ সংক্রান্ত যে আন্তর্জাতিক কমিটি রয়েছে তারা তাদের রিপোর্টে বলছে, কার্বন নিঃসরণের ক্ষেত্রে সমগ্র বিশ্বের মাত্র ৪% আফ্রিকার দেশগুলো থেকে হয়। কিন্তু মানুষ-সৃষ্ট প্রকৃতির খামখেয়ালিপনায় আফ্রিকায় কৃষি জমির বিপুল হ্রাস হবে, খরা হবে এবং, পরিণতিতে, খাদ্য সুরক্ষা এবং সামগ্রিক পুষ্টি আরও আক্রান্ত হবে। ইন্টারন্যাশনাল রেডক্রস অ্যান্ড রেড ক্রিসেন্ট মুভমেন্ট-এর সাম্প্রতিক তথ্যও একই হিসেব জানাচ্ছে।
জানুয়ারি ১১, ২০২৪-এ নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর মতো আন্তর্জাতিক জগতে প্রভাবশালী সংবাদপত্রে প্রকাশিত একটি বৃহৎ প্রতিবেদনের শিরোনাম – “হোয়াট হ্যাপেনস হোয়েন দেয়ার ইজ নো ফুডঃ এক্সপার্টস সে সিভিয়ার ম্যালনিউট্রিশন কুড সেট সুইফটলি ইন গাজা”। এ প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে – “একটি অপুষ্টি-আক্রান্ত শরীর প্রতিরোধহীন – ত্বকের একেবারে ওপরে যে এপিথিলিয়াল কোষ থাকে তারা এবং অন্ত্রের ভেতরে যে কোষেরা আবরণ তৈরি করে সেগুলো ভেঙ্গে যায়। প্রতিরোধক্ষমতাও হারিয়ে যায়। শ্বেত রক্ত কণিকা সঠিক নিয়মে কাজ করেনা।” ঘটনাটি গাজার বলে আমরা প্রতিবাদ করতে পারি, সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দিতে পারি। আমাদের বিবেকের একটি অংশ আমাদের এগুলো করতে বলে।
আফ্রিকা কিংবা গাজা নিয়ে আমাদের ঘুমন্ত বিবেক এবং বিবশ হয়ে-যাওয়া সামগ্রিক চৈতন্যের হঠাৎ করে “গুংগা রবে” মৌহূর্তিক জাগরণ হতেই পারে। কিন্তু আমাদের দেশে, আমাদের ঘরের মধ্যেই যদি এরকম ঘটনা ঘটে? চিকিৎসক, বিবেকী মানুষ কিংবা সমাজকর্মী হিসেবে আমরা কি করব?
মান্য মেডিকাল জার্নাল ল্যান্সেট -এ একটি দীর্ঘ স্টাডি (মার্চ ৩০, ২০২৩) প্রকাশিত হয়েছিল – “প্রিভ্যালেন্স অফ জিরো-ফুড অ্যামং ইনফ্যান্টস অ্যান্ড ইয়ং চিলড্রেন ইন ইন্ডিয়াঃ প্যাটার্নস অফ চেঞ্জ অ্যাক্রস দ্য স্টেটস অ্যান্ড ইউনিয়ন টেরিটরিজ অফ ইন্ডিয়া, ১৯৯৩-২০২১”। অর্থাৎ, দীর্ঘ ২৮ বছর ধরে ভারতের রাজ্য এবং ইউনিয়ন টেরিটরিগুলোতে “জিরো-ফুড”-এর প্রভাব শিশু এবং অল্পবয়সী বাচ্চাদের ক্ষেত্রে কিরকম প্রভাব ফেলেছে, তার একটি ফলাফল এই স্টাডিতে প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৯৩, ১৯৯৯, ২০০৬, ২০১৬ এবং ২০২১-এ ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভে-তে (এনএফএইচএস) যে তথ্য এবং পরিসংখ্যান মিলেছে সেসবের বিশ্লেষণ করা হয়েছে। মোট ১৭৫,৬১৪ জন শিশুর স্যাম্পল সার্ভে করা হয়েছে। সহজেই বোধগম্য, স্টাডির সময়সীমা এবং সংখ্যা বিপুল। কোন যুক্তিতেই একে নস্যাৎ করা মুশকিল। এবার প্রশ্ন আসবে, জিরো-ফুড বিষয়টি কি? ল্যান্সেট-এর প্রতিবেদন ব্যাখ্যা করেছে, যখন কোন শিশু বা কিশোর ২৪ ঘন্টা সময়কালে প্রায় কোন ধরনের খাবার পায়নি, খায়নি। এ প্রতিবেদনই জানাচ্ছে, ১৯৯৩ সালে “জিরো-ফুড”-এর শতকরা হিসেব (২০.০%) থেকে ২০২১ সালে সামান্য কমেছে (১৭.৮%)।
হিসেব বলে, ভারতে ৬৭ লক্ষ শিশু সারাদিনে একবারও খাবার পায়না। সংখ্যাটি নেহাত ফেলনা নয়। একাধিক দেশের জনসংখ্যার প্রায় সমান বা বেশি। আফ্রিকার দেশ গিনি (২১.৮%) এবং মালি-র (২০.৫%) পরেই ২০২১-এর তথ্য অনুযায়ী ভারতের অবস্থান (১৭.৮%)। বাংলাদেশে এ হিসেব ৫.৬%, ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক কঙ্গোতে ৭.৪%, নাইজেরিয়া-য় ৮.৮% এবং ইথিওপিয়াতে ১৪.৮%। এ শিশুদের মুখে কে খাদ্য জোগাবে? এতো রাষ্ট্রেরই দায়িত্ব হবার কথা ছিল।
১২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪-এ JAMA Network-এ প্রকাশিত স্টাডির শিরোনাম “প্রিভ্যালেন্স অফ চিলড্রেন এজেড ৬ টু ২৩ মান্থস হু ডিড নট কনজিউম অ্যানিম্যাল মিল্ক, ফর্মুলা, অর সলিড অর সেমি-সলিড ফুড ডিউরিং দ্য লাস্ট ২৪ হাওয়ার্স অ্যাক্রস লো- অ্যান্ড মিডল-ইনকাম কান্ট্রিজ”। এই স্টাডিতে মন্তব্য করা হয় – “ভারতের জিরো-ফুড শিশুদের হিসেব এই স্টাডিতে প্রায় অর্ধেক জায়গা দখল করে আছে।” আরও বলা হয়, এ পর্যবেক্ষণ পশ্চিম এবং মধ্য আফ্রিকা এবং ভারতের পক্ষে উদ্বেগজনক। ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের মধ্যে এই খাদ্য-শূণ্যতার মাত্রার এবং সংখ্যার পার্থক্য আছে। ল্যান্সেট-এ প্রকাশিত স্টাডির ক্ষেত্রে ভারত সরকারের তরফে সেরকম কোন প্রতিক্রিয়া চোখে না পড়লেও, JAMA Network-এ প্রকাশিত স্টাডির ক্ষেত্রে ভারত সরকারের নারী ও শিশু বিকাশ মন্ত্রকের তরফে বড়ো হরফে বিবৃতি দিয়ে বলা হয় – “১২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪-এ JAMA Network-এ প্রকাশিত ভারতের তথাকথিত ‘জিরো-ফুড’-এর ওপরে প্রকাশিত প্রতিবেদনটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং বিদ্বেষপরায়ণ একটি প্রচেষ্টা যা ফেক নিউজ-কে চাঞ্চল্যকর করে তোলার লক্ষ্যে কাজ করেছে”।
একটি সঙ্গত প্রশ্ন আসতে পারে, ল্যান্সেট-এর স্টাডির ক্ষেত্রে অনেকটা নীরবতা থাকলেও JAMA Network-এর ক্ষেত্রে এরকম তীব্র প্রতিক্রিয়া হল কেন? সম্ভাব্য কারণ হতে পারে – (১) আমেরিকান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের মুখপত্র হল এই জার্নাল। ফলে, হয়তো বা এর অভিঘাত বেশি হতে পারে, (২) প্রতিবেদন প্রকাশের বিশেষ সময় – ফেব্রুয়ারি, ২০২৪। নির্বাচন দোরগোড়ায়। এরকম পরিস্থিতিতে এ ধরনের প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে অন্তত চিকিৎসক ও শিক্ষিত সমাজের মাঝে এর অভিঘাত পড়তে পারে। পরিণতিতে ভোটের বাক্সেও এর ছাপ সামান্য হলেও দেখা যেতে পারে। নির্বাচনের আগে কোনরকম কাঁটা রাখা রাষ্ট্রের পরিচালক দলের পক্ষে শুভ নয়। (৩) যখন বিভিন্ন ধরনের কথা ও নির্বাচিত বাগধারার মাধ্যমে দেশের সমৃদ্ধি ও বিকাশ বিজ্ঞাপিত হচ্ছে, সেসময়ে ভারত শিশুদের খাদ্য সুরক্ষার ক্ষেত্রে আফ্রিকার দেশগুলোর সঙ্গে একাসনে বসবে বা বাংলাদেশ, এমনকি আফ্রিকার কয়েকটি দেশের পেছনে থাকবে, এরকম একটা বিষয় আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তির পক্ষে যথেষ্ট ক্ষতিকারক। এসব কারণে বা আরও কিছু অজানা হিসেবে এরকম তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে ভারত সরকারের তরফে।
(সূত্র: টেলিগ্রাফ)
প্রসঙ্গত বলার, পৃথিবীতে স্বীকৃত এবং পিয়ার-রিভিউড একটি পদ্ধতি হল “গ্লোবাল হাংগার ইনডেক্স” বা “বিশ্ব ক্ষুধা সূচক”। ২০২৩ সালে যে ১২৫টি দেশের ক্ষেত্রে যথেষ্ট পরিমাণ ও নির্ভরযোগ্য ডেটা পাওয়া গেছে তাদের ভিত্তিতে যে ক্ষুধা সূচক তৈরি হয়েছে সে সারণিতে ভারতের অবস্থান ১১১ নম্বরে। এই সূচকে ২০ থেকে ৩৪.৯ স্কোরকে উদ্বেগজনক বলে ধরা হয়। ভারতের স্কোর ২৮.৭। ২০১৫-তে এ স্কোর ছিল ২৯.২। ফলে সামান্য উন্নতি হয়েছে বলা যায়।
ভারতের ক্ষেত্রে খাদ্য সুরক্ষা, পুষ্টির সুরক্ষা এবং নাগরিকদের সুরক্ষার প্রশ্নটি এবার বিবেচিত হওয়া উচিত। ভোট আসে, ভোট যায়, কিন্তু শিশুরা উপেক্ষিতই থেকে যায়। এর অবসান হওয়া একান্ত জরুরি। শিশুরা আমাদের বলছে – “আমাদের শুকনো ভাতে লবণের ব্যবস্থা হোক”!
খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেদন পড়লাম ।
Few days ago similar subject was elaborated on increment of our GDP. in Ananda Nazar Patrika ,where it was suggested to include nutrition as parameter to be observed and should not be diluted with other measuring parameters as applied and few other parameters better to be curtailed while trying to assess the economic improvement Starvation cannot be ignored.
When we straightway assess a person how he is doing, we look at his/her stomach and then the pocket ( Food and purchasing capacity). So, there lies the importance of measuring starvation.
I have not gone into the full articles as mentioned. So not in a position to comment. But this much I would say that point observation (24hrs) and random selection at a point carry more bias as compared to period observation with large number of subjects ( Which is desirable)to know the truth.
Expecting unbiased opinion from the learned Statisticians regarding the issue.
NOW THE TIME HAS COME TO BE CONCIOUS .
খুব ভালো লাগলো প্রতিবেদনটি পড়ে।