২২শে শ্রাবণ
আজকের দিনে যে মানুষটি আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন তিনি আমাদের মধ্যে কতটা জড়িয়ে ছিলেন তার ব্যাপ্তি হিসেবে চারটে ছোট্ট গল্প শোনাবো। সরি, গল্প নয়, সত্যি ঘটনা।
ঘটনা এক।
সুদূর বিদেশের। “ঘটনাটা ঘটেছিল পোল্যান্ডের বুকে। ১৯৪২ সাল, পোল্যান্ড তখন পুরোপুরি নাৎসি সেনাদের দখলে। ৩৫ লক্ষ ইহুদি জানেন না আদৌ এই সময় পেরিয়ে যেতে পারবেন কিনা। ধরে ধরে মানুষকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে। হয় তাঁদের ক্রীতদাসের মতো খাটানো হচ্ছে, আর নয়তো মেরে ফেলা হচ্ছে। সেইসময় পোল্যান্ডের ওয়ারশ শহরের বুকে একটি অনাথ-আশ্রম গড়ে তুলেছিলেন ইয়ানুস কোরচাক নামে এক ব্যক্তি। তাঁর আশ্রমের প্রায় ২০০ বালক-বালিকার সকলেই ইহুদি। তাদের জোর করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল ইহুদি ঘেটোতে। ঘেটো মানে বিরাট উঁচু প্রাচীর দিয়ে ঘেরা জেলখানা। সেই সময়েও শিশুদের হাত ছেড়ে দেননি কোরচাক। তিনিও আশ্রয় নিলেন সেই ঘেটোর মধ্যেই। সেখান থেকে প্রতিদিন শত শত মানুষকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ত্রেবলিনকা মৃত্যুকূপে। কাউকে আবার প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করা হচ্ছে। তাঁদের একমাত্র অপরাধ তাঁরা ইহুদি। মৃত্যু আর বেশি দেরি নেই। এই সত্যিটা বুঝতে সময় লাগেনি। আর এই মৃত্যুচেতনার মধ্যে সেদিন আবারও আশ্রয় দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। কবি নিজে ততদিনে পাড়ি দিয়েছেন সেই পাঁচমুড়ো পাহাড়ের নিচে, শ্যামলী নদীর ধারে – আর এই অসহায় শিশুদের গন্তব্যও সেখানেই। খুব শিগগিরি। নিশ্চিত মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত ছিলেন কোরচাক। কিন্তু এই শিশুরা! এদের তিনি প্রস্তুত করবেন কীভাবে? ঠিক করলেন সেই ইহুদি ঘেটোর মধ্যেই একটি নাটক অভিনয় করাবেন শিশুদের দিয়ে। কী সেই নাটক? নাটকের নাম ‘পোচতা’। পোলিস ভাষায় যার অর্থ ‘ডাকঘর’। হ্যাঁ, ১৮ জুলাই ১৯৪২, রবীন্দ্রনাথের সেই অমল আর দইওয়ালার কথোপকথনের সাক্ষী ছিল সেদিন ঘেটোর মধ্যে মৃত্যুর জন্য দিন গুনতে থাকা অসংখ্য মানুষ। যেখানে মৃত্যুপথযাত্রী অমল তার নিশ্চিত ভবিষ্যতকে গ্রহণ করেছে আবিষ্কারের আগ্রহে। নাটকে অবশ্য অমল তার কাঙ্খিত রাজার চিঠি হাতে পায়নি। কিন্তু ইহুদি ঘেটোর সেই শিশুরা শমন পেল কিছুদিনের মধ্যেই। ৬ আগস্ট ১৯৪২, অর্থাৎ নাটকের অভিনয়ের ঠিক আড়াই সপ্তাহ পর কোরচাক, তাঁর সমস্ত সহকর্মী এবং ১৯৫ জন অনাথ বালক-বালিকাকে চলে যেতে হয় ত্রেবলিনকায়।অদ্ভুত এক দৃশ্যের সাক্ষী ছিল সেদিন নাৎসি বাহিনী। কোরচাকের পিছনে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়েছে সমস্ত বালক বালিকা। একে একে তারা এগিয়ে যাচ্ছে মৃত্যুকূপের দিকে। কারোর চোখেমুখে কোনো ভয় বা আতঙ্ক নেই। মৃত্যুকে তারা গ্রহণ করেছে সহজ ভাবেই। আর সেই নির্ভীক দৃষ্টি যেন আবারও রবীন্দ্রনাথের সেই কথাই মনে পড়িয়ে দেয়, ‘আমি মৃত্যুর চেয়ে বড়।’
ঘটনা দুই।
ঘরের কাছে। বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের সময় নিউইয়র্কের পাকিস্তান রাষ্ট্রদূত দপ্তরের কর্মচারীরা দোটানায় পড়েছিলেন। কোনদিকে থাকবেন, একদিকে ফরেন সার্ভিসের উঁচু লোভনীয় পদ, পোস্টিং অন্যদিকে চালচুলোহীন নবীন রাষ্ট্র তৈরি হলেও হতে পারে। মন্ত্রী এনায়েত করিমকে তাঁর বন্ধু কথা সাহিত্যিক ও কবি শওকত ওসমান মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের আহবান জানিয়ে একটি চিঠি লেখেন। চিঠিটি পাঠ করে করিম সাহেব ও আরো চোদ্দজন বাঙালি রাজপুরুষ মনস্থির করে পদত্যাগের পরে যোগ দেন মুক্তি সংগ্রামে। পরে ওরা বলেছিলেন যে ওসমানের চিঠির শেষ চারটে লাইন তাঁদের নতুন করে ভাবতে শেখায়। সেই লাইনগুলি ছিল: ‘জমা হয়েছিল আরামের লোভে/ দুর্বলতার রাশি,// লাগুক তাহাতে লাগুক আগুন,/ ভস্মে ফেলুক গ্রাসি।’
ঘটনা তিন।
নিজের দেশের মাটিতে।।..জেলার সাহেব আমাদের নারায়নদা ও নিরঞ্জনদা (ডা নারায়ণ রায় ও নিরঞ্জন সেন সেলুলার জেলে বন্দী দুই বিপ্লবী ও পরে কম্যুনিস্ট আন্দোলনের নেতা)কে একটু দূরে ডেকে নিয়ে বললেন, দুঃখের বিষয় মোহন, মোহিত ও মহাবীর (১৯৩৩ সালের অনশন ধর্মঘটের তিন শহীদ মোহনকিশোর নমদাস, মোহিত মৈত্র ও মহাবীর সিং) তিন জনেই মারা গেছে। সন্দেহ সত্য বলে প্রমাণিত হল। বন্দীদের মুখে কোনো কথা নেই। নীরব প্রতিজ্ঞার মাঝে শুধু অশ্রু ঝরছে। এর পর থেকে অনশন শেষ না হওয়া পর্যন্ত আর ‘সেল’ খোলে নি। ২৪ ঘন্টা সেল বন্ধ। এই আবদ্ধ অবস্থায় সেল থেকে সেলে চিৎকার করে জানিয়ে দেওয়া হল – আরো বেশিদিন টিঁকে থাকতে হবে, চালিয়ে যেতে হবে। বন্ধুরা গান ধরল: ‘নাই নাই ভয়, হবে হবে জয়, খুলে যাবে এই দ্বার’।
ঘটনা চার।
হৃদয়ের আরো কাছাকাছি। ১৯৩৮ সাল। রানীগঞ্জের কাছে বল্লভপুর পেপার মিলে শ্রমিক ধর্মঘট – তাতে পিকেটিং জোরদার করতে হবে। কর্মীরা সবাই জড় হয়েছে। ইউনিয়নের তরুণ নেতা কমিউনিস্ট কর্মী সুকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় কিছুদিন মাত্র বিয়ে করেছেন। নববধূ মিনতি করে চিঠি লিখেছিলেন সংগ্রামের আগে একবার দেখা করে যেতে। সুকুমার যেতে পারেন নি -আসন্ন কঠিন সংগ্রামের প্রস্তুতির কাজে। কর্মীরা সবাই জড়ো হয়েছেন। একজন হঠাৎ বললেন, “সুকুমার, আজ একটা গান করুন না। কাল থেকে তো আর নিশ্বাস ফেলার সময় পাওয়া যাবে না।” উচ্চবাচ্য না করে হাতের চায়ের পেয়ালা এক চুমুকে শেষ করেই গান ধরলেন, ‘যাও,যাও,যাও গো এবার যাবার আগে রাঙিয়ে দিয়ে যাও।’ সবাই অবাক হয়েছিল, কি মিষ্টি গলা। প্রাণ ঢেলে গাইলেন। গান থামতেই সবাই সমস্বরে বলে উঠল – ‘আর একটি’।। বিনয় নম্র হেসে গলা ছেড়ে ধরলেন –‘ওগো সুন্দর’। সবাই মুগ্ধ হয়ে শুনলে। সে গানের আওয়াজ কি গিয়ে পৌঁছল সেই বিশেষ ব্যাকুল হৃদয়ের কাছে। এর কয়েকদিন পরেই পিকেটার সুকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের দেহ নিষ্পিষ্ট হয়ে গেল মালিকের লরির চাকার তলায়। পুলিশের সাহায্যে ধর্মঘট ভাঙার জন্য লরিতে করে মালিক লোক আনছিল বাইরে থেকে।
এই মানুষটি আমাদের ছেড়ে কোথায় যাবেন? আমরাই বা কোথায় যাবো তাঁকে ছেড়ে? আমাদের ঠাকুর তো একটাই। রবি ঠাকুর।