আমার ছোটবেলায় শীত আসত একটা লাল কালো হাফ সোয়েটারের হাত ধরে। মায়ের বোনা প্রথম পশমী কাজ, আমার জন্য। তাতে বিশাল বড় বড় বোতাম লাগানো ছিল লাল-কালো স্বচ্ছ প্লাস্টিকের। আমার শৈশবের বহু একাবোকা শীতের দুপুর কেটে গেছে ঐ বোতামগুলো ঘরে ঢোকানো আর খোলার খেলা খেলতে খেলতে — ছোট্ট আঙুলে খেটেখুটে কাজটা করতে হতো তো!
মাঙ্কিক্যাপ পরা বিহারি গয়লা আসতো লম্বা অ্যালুমিনিয়ামের ক্যান সাইকেলে চাপিয়ে, আর আমি আমার বুড়োদাদুর বাড়ির ফাটা সিমেন্টের রোয়াকে বসে হাঁ করে দেখতাম সামনের বাগানের ঘাসের শিশিরবিন্দুর মাথায় এসে পড়েছে সকালের ঝাঁঝহীন নরম রোদ — আর ঘাসের মুকুট থেকে ঠিকরে উঠছে রামধনুর সাতটা রঙ।
বেলা গড়ালে মা ফুলকাটা ছোট কাঁসার রেকাবিতে এনে দিত মুচমুচে পরোটা আর গাঢ় খয়েরি রঙের খেজুর গুড়। থালাটা হেলিয়ে ধরলে দানা ছাড়িয়ে গড়িয়ে আসত ঘন তরল। সেইটুকু চেটে খেতে তখন অপার্থিব আনন্দ।
বাবার চাকরি বদলের সুবাদে কলকাতার উত্তর উপকন্ঠ ছেড়ে আমরা চলে গেলাম খড়্গপুরে। আর সেই প্রথম বছরেই টের পেলাম হাড়ে কাঁপন লাগা ঠান্ডা কাকে বলে। শিউলি কুড়োনো শরৎকালের ভোর থেকেই সেখানে অল্প অল্প শীত পড়তে আরম্ভ করত, আর শেষ ডিসেম্বরে ফুলহাতা উলের ব্লাউজ আর চাদর গায়ে মাকে রান্নাঘরে বসে রুটি বেলতে দেখতাম — আগুনের তাতে তখন কষ্ট নেই, বরং আরাম।
তারপর পরিযায়ী পাখিদের মতো আরো কতশত জায়গা ঘুরে কেটে গেল বাল্যকাল, কৈশোর, প্রথম তারুণ্য।
ভর্তি হলাম ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজে, ঠাঁই হলো চারতলা হোস্টেলে। আমার ছেলেবেলার দিগন্ত ছুঁয়ে থাকা ধূসর কুয়াশামাখা গম্ভীর শীত পড়ত না শহর কলকাতায়। দিবারাত্র বাসের গর্জন, ট্রামের ঘর্ঘর, আর অজস্র গোল, লম্বা, চৌকো, ত্রিকোণ মানুষজনের হট্টগোলে শীত বেচারা থিতু হয়ে বসার জায়গাই পেতো না অত জমকালো শহরবাড়িটায়।
বড়দিন থেকে পৌষ সংক্রান্তির মাঝখানে কষ্টেসৃষ্টে ঠেলেঠুলে ঢুকে নিজেকে ক্ষীণভাবে জাহির করত কলকাত্তাইয়া শীত, আর তাকে সম্মান করতেই আমরা হোস্টেলের বান্ধবীরা হামলে পড়তাম পার্ক সার্কাসের ময়দানি শীতবস্ত্রের মেলায়। তাতে কাশ্মীরী দোকানিরা খুশি হলেও আমাদের ট্রাঙ্ক সুটকেসগুলো মোটেও খুশি হতো না। কারণ, এক আধবার গায়ে তুলেই বাক্সে তুলে রাখতে হতো গরম জামাগুলো, ঠিক যেমন হোস্টেলের লোহার খাটে বাবার দিয়ে যাওয়া হৃষ্টপুষ্ট লেপটা প্রায় সারাবছরই আমার তোশকের ভূমিকা পালন করতো — শয্যাটি আরামদায়ক হতো অবশ্য।
তা জবরদস্ত ঠান্ডা পড়ুক বা না পড়ুক, শীত মানেই ছিল ‘মেরি ক্রিসমাস’। অ্যালেন পার্কের বড়দিন কার্নিভাল তখন ভবিষ্যতের গর্ভে। আর বো ব্যারাক নিশ্চয়ই ছিল তার অনন্য উদযাপন আর কেক ওয়াইনের পসরা নিয়ে, তবে অঞ্জন দত্ত ছাড়া সেই নব্বই দশকের গোড়ায় বিশেষ কেউ তার খবর রাখত না।
ক্যাথলিনের পেস্ট্রি আর গড়িয়াহাট থেকে শখ করে কিনে আনা চকচকে সবুজ ঝালরের ক্রিসমাস ট্রি, নানা রঙের ঝকমকে বল, বেলুন, কাগজের ফিতে দিয়ে একফালি হোস্টেল রুমটাকে সাজিয়ে নিয়ে চলত আমাদের যিশুর জন্মোৎসব পালন।
আর কোনো কোনো দিন রাত গভীর হলে বন্ধুরা মিলে চলে যেতাম পাঁচতলার ছাদে — গল্পগাছার ফাঁকে কানে আসত হাতির বৃংহণ আর পশুরাজের গর্জন। আমরা চুপ করে শুনতাম পার্ক সার্কাস ময়দানের সার্কাসের তাঁবুতে খাঁচায় বন্দী অসহায় জানোয়ারগুলো কাকে যেন ডেকে ডেকে বেড়াচ্ছে।
আমার সরকারি চাকরির প্রথম পোস্টিং হয়েছিল উত্তরবঙ্গের এক অশ্রুত, অখ্যাত আধা মফস্বল টাউনে। উত্তর দিনাজপুরের কালিয়াগঞ্জে।
সেই কালিয়াগঞ্জ শহরের শীত এতাবৎ আমার অনুভব করা সবচেয়ে নির্মম ঠান্ডা — দিল্লির ঠান্ডাকেও গুণে গুণে পাঁচ গোল দেওয়ার মতো শীত। স্বাভাবিক পরিধেয়র উপরে একখানা ফুল সোয়েটার, তারপর জ্যাকেট, শাল চাপিয়ে মোটা মাফলারে কান মাথা ঢেকে, উলের মোজা আর পা ঢাকা জুতোয় সজ্জিত গুজ্জিত হয়েও সে ঠান্ডা কাটতে চাইত না। তার উপর ছিল মারাত্মক কুয়াশা। দিনের পর দিন রোদ উঠত না — উঠলেও বেলা বারোটা একটা নাগাদ অনিচ্ছুক, ম্রিয়মাণ কয়েকটি কিরণ উঁকি দিত এক আধঘন্টার জন্য — তারপর আবার মুখ লুকোত বিষণ্ণ ধূসরতায়।
আউটডোরে রোগী আসত কম। এলেও প্রেসক্রিপশন লিখতে হাত উঠত না, সে হাত তখন জ্যাকেটের পকেটের ওম ছেড়ে বেরোতে চাইত না মোটে। রাত্রে ধড়াচুড়ো না খুলেই ডবল লেপের নিচে চালান করে দিতাম নিজেকে, নাইট ডিউটির সময় কান্না পেয়ে যেত। সবচাইতে রাগ হতো যখন শহরের আদি বাসিন্দারা কেউ কেউ আমাদের শীতকাতুরে, কম্বুলে চেহারা দেখে হেসে বলতেন —‘ এ বসর শীত তো কিসুই পড়ে নাই ত্যামন, সংক্রান্তি আসুক, তহন বুঝবেন’ —
শুনেছিলাম কালিয়াগঞ্জ থেকে দার্জিলিংএর হাওয়াই দূরত্ব নাকি বেশি নয়, তাই অত জাঁকিয়ে শীত পড়ে সেখানে।
তারপর? জীবন গিয়েছে চলে আমাদের কুড়ি কুড়ি বছরের পার —- এখন আমার অন্তরে গুটিশুটি হয়ে শুয়ে ঘুমোয় একটা ঠান্ডা রক্তের বুড়ো সরীসৃপ। প্রখর গ্রীষ্মের দিনেও আজকাল আমার শীত করে ওঠে বড্ড।
ঠাকুমার পৌষলক্ষ্মীর পুজোর কড়ি আর যত্নে বোনা নকশিকাঁথার মতো হারিয়ে গিয়েছে শৈশব আর কিশোরবেলা। অগস্ত্যযাত্রায় চলে গেছে যৌবনের ঝোড়ো, উদাত্ত দিনগুলো। শীতশুরুর সবুজ ইডেনের মন্থর, মজলিসি টেস্ট ম্যাচ আর মায়ের হাতের আশকেপিঠের মতো সেইসব দিন আর ফিরবে না। যেমন ফিরবে না সেই প্রথম পরা লাল-কালো সোয়েটারটা, বাবার আনা শীতের প্রথম কনকচূড় ধানের খইমাখা নতুন গুড়ের ‘জয়নগরের মোয়া’র বাক্স আর দু’চোখে অনাঘ্রাত বিস্ময় নিয়ে মা-বাবার হাত ধরে একটা সাত বছরের বালিকার শীতার্ত নেতারহাটে প্রথম সূর্যোদয় দেখা।
দিন দিন সুন্দরবনের বাঘের দন্ডি কাটার মতো ছোট হয়ে আসে পরিচিত পরিজনের গন্ডি। বেলা ছোট হয়, দীর্ঘ হয় অবকাশ। সূর্য ঢলে পশ্চিমে, আমি ভীতমুখে অপেক্ষা করি খেলা শেষের বাঁশির।
আমার ক্যালেন্ডারে এখন বারোমাসই শীতকাল।
এই রচনাটির ঈষৎ সংক্ষেপিত রূপ উত্তরবঙ্গ সংবাদ-এ প্রকাশিত।