সব কোলাহল থেমে গেল। যাকে বলে পিন পতন স্তব্ধতা!
নিউটাউনের ফ্ল্যাটে এসে দেখি ওরা নেই। সিকিউরিটিকে জিজ্ঞেস করতে বলল, – “দাদা, ইলাহি কারবার। কমিউনিটি হলে আছে স্যার আর ম্যাডাম। আজ উনাদের অ্যানিভার্সারি। সবার নিমত্তন্ন।আমরাও যাব শিফট শেষ হলেই। ওঃ স্যারকে না? ম্যাডামকে খুঁজছেন? আপনি ম্যাডামের কে হচ্ছেন বটে? রিলেটিভ? যান উখানে।”
কমিউনিটি হলে এসে দেখি সত্যিই ব্যাপার এলাহি। পান ভোজনে গমগম করছে বিশাল হলটা। বিশাখা আর ওর বর অমৃত ভারি ব্যস্ত, অতিথি আপ্যায়নে। অস্থিচর্মসার আমাকে এই ঘরে মানায় না।
বিশাখা একটু অপ্রস্তুত ভাবে অমৃতর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিল। অমৃত দ্রব্যগুণেএকটু টিপসি। বলল, ” ওঃ, আপনিই তিনি? বিশাখার সেই প্রাক্তন?”
হ্যাঁ৷ প্রাক্তনই। পাশটাশ করে চাকরি পাইনি বলে আমি তখন বেকার। আমার মা মরে যাবার পর এলোমেলো হয়ে গেল সব। এই কর্পোরেট পাত্রটি এসে যাওয়ায় বিশাখা তার মা বাবাকে না করতে পারেনি।
হই হই করে সবাইকে সচকিত করে, অমৃত আবার বলল, – “লেডিজ অ্যান্ড জেন্টলমেন! আমার এই বন্ধুটি সুদূর মেদিনীপুর থেকে আজকের অনুষ্ঠানে এসেছেন, স্রেফ আমাদের কনগ্র্যাচুলেট করতে।” বলেই চেঁচিয়ে বলল,
“অ্যাই, স্যারকে প্লেট দাও।”
বাধ্য হয়েই আমাকে বলতে হল, “খাওয়ার উপায় নেই আমার। আর ঘণ্টা দুয়েক বাদে ভর্তি হব। আমার কেমো শুরু হবে। পাশেই টাটা মেডিকেলে। খালি পেটে থাকতে হবে।”
আজ সপ্তম সাইকেল। মোট আটটা দেবে। স্টমাকের ক্যান্সার।
এই রকমের আগেও ঘটেছে। এই যে সবাইকে এক সঙ্গে চুপ করে থাকার প্রেরণা দেওয়া! ক্লাসে বাংলায় রচনা লেখার আগে স্যার এক এক করে দাঁড় করিয়ে জিজ্ঞেস করছিলেন, কার জীবনের উদ্দেশ্য কী। যে যার মত বলছিল। কেউ শিক্ষক হতে চায়, কেউ ডাক্তার, কেউ বিজ্ঞানী এই রকম আরও কত কী। আমি লাস্ট বেঞ্চে। রোল নাম্বার বত্তিরিশ।
উঠে থতমত দাঁড়িয়ে আছি দেখে স্যার তাড়া দিলেন, কী রে বল! ইদিকে সবাই তো সব কিছু হয়ে গেল ক্লাসশুদ্ধু!
আমি অকম্পিত নির্ভীক স্বরে বললুম, – স্যার, আমি রিটায়ার্ড হতে চাই!
আসলে ক’দিন আগেই রিটায়ার্ড অবিনাশ জ্যাঠা বাবাকে বলছিল রিটায়ার্ড হবার মত সুখ কিছুতে নেই।
মাইরি বলছি অনুভব করলাম, উনি শুদ্ধ পুরো ক্লাস হতবাক হয়ে গেল।
সারা ক্লাসে আর শেষের ক’মিনিট কোনও কথা বলল না কেউ। স্যারও না। ক্লাস শেষের ঘণ্টা পড়তে রোল কলের খাতাটা নিয়ে একটু ঝুঁকে পড়া অবসন্ন ভঙ্গিতে স্যার বেরিয়ে গেলেন। মনে হল উনিও আমার এই দুঃসহ হতে চাওয়া শুনে রিটায়ার্ডই হতে চাইছেন।
আজকেও সবাইকে নিস্তব্ধ করে দিতে পেরেছি। যদিও আসবার কারণটা বলতে পারিনি। সত্যিই রিটায়ার্ড হয়ে যাব জীবন থেকে শিগগিরই।
এসেছিলাম, আমারই মায়ের গলার তিনভরির হার, যেটা বিশাখাকে, মানে তার ভেবে নেওয়া ভাবী পুত্রবধূর হাতে একদা আশীর্বাদ করে দিয়েছিল মা, যদি ফিরিয়ে দেয়! কপর্দকহীন এই আমার অষ্টম কেমোটা নেবার পয়সা নেই।