বাতাসে অতিমারীর দ্বিতীয় তরঙ্গের ভ্রুকুটি! শেষ সপ্তাহ দুয়েকে আবার ধীরে ধীরে কোভিড আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে শুরু করেছে। টিকাকরণ শুরু হলেও এখন অব্দি টিকা পেয়েছেন দেশের জনসংখ্যার এক শতাংশেরও কম মানুষ। অর্থাৎ, জনসংখ্যার বেশিরভাগ অংশই অসুরক্ষিত। এদিকে কোভিড ঘিরে যেটুকু সামান্য সচেতনতা অবশিষ্ট ছিল সেটুকুও উধাও। পূজাপার্বণ, জলসা, মোচ্ছব, আড্ডা, মেলা, খেলা সব আবার আগের জায়গায় ফিরে গেছে। ভোট ঘোষণা হয়ে গেছে। প্রায় প্রতিদিনই কোনও না কোনও রাজনৈতিক দলের মিছিল কিংবা সমাবেশ লেগেই আছে। কোন দলের সমাবেশে কত ভিড় তা নিয়ে রীতিমতো তরজা চলছে। সমাবেশ দাঁড়িয়ে তোলা ছবিতে স্যোশাল মিডিয়া ছয়লাপ। দেশে যে কোভিড বলে কোনও রোগ আছে সেটা ভাবতেই রাজি নয় কেউ। অনেকে আবার একধাপ এগিয়ে স্বাস্থ্যকর্মীদেরই ‘ভ্যাক্সিনের দালাল’ বলে দেগে দিচ্ছেন। আরও স্পষ্ট করে কেউ কেউ বলে দিচ্ছেন, “কোভিড-ফোভিড আসলে চক্রান্ত” কিংবা “শুয়োরের বাচ্চা ডাক্তার শালা পাবলিকের কাছে ভয় বেচে খায়।”
মৃত্যু আর যন্ত্রণা নিয়ে আমাদের রোজনামচা। রক্ত আর কফ ঘেঁটে আমাদের বৈকালিক বা সান্ধ্যআসর। নিথর দেহগুলো পেছনে রেখে আমাদেরকেই বলতে হয়, ‘নাঃ! আর নেই’। পিপিই পরে ডিহাইড্রেশন আর র্যাশ নিয়ে আমাদেরই ধুঁকতে হয়। তাই একসময় খুব রাগ হ’ত। এসব মন্তব্য শুনলে কোমর বেঁধে ঝগড়া করতে যেতাম। আজকাল আর ইচ্ছেও হয় না। শুধুমাত্র নিজের দায়িত্ববোধের তাড়নায় কথাগুলো বলে যাই। আগেও লক্ষবার বলেছি, আরও লক্ষবার বলবো… মাস্ক পরুন, মাস্ক পরুন, মাস্ক পরুন শালা! আপনার ঈশ্বর, না-ঈশ্বর অথবা আঁতলামোর দোহাই, মাস্ক পরুন। এই খুল্লমখুল্লা পরিস্থিতিতে যদি সত্যি সত্যি সাংঘাতিকভাবে দ্বিতীয় তরঙ্গ আছড়ে পড়ে… আর ভাবতে ইচ্ছে করছে না। ধুঁকতে থাকা নগ্নপদ শ্রমিক, রেললাইনে কাটা মৃতদেহ, হঠাৎ কাজ হারানো, যানবাহন বন্ধ… খুব বেশিদিন আগের ঘটনা নয়।
লাল-নীল-সবুজ-গেরুয়া কোনও রাজনৈতিক দলের কাছেই কোনও প্রত্যাশা নেই। সবাই নিজের নিজের মতো করে ভোট খেলায় নেমে পড়েছেন। কাউকে ফোন করতে গেলে প্রতিবার ‘মাস্ক পরুন, হাত ধোবেন’ শুনতে শুনতে কান পচে গেল। রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীদের ছবিসহ পোস্টারেও একই আবেদন। অথচ, তাঁদেরই রাজনৈতিক প্রচারে স্বাস্থ্য-সচেতনতার ‘স’ টুকুও নেই। এই আমাদের দেশ এবং এই আমাদের জন-প্রতিনিধি।
আউটডোরে কাশি-শ্বাসকষ্ট-জ্বরের রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। আবহাওয়ার পরিবর্তন নিশ্চয়ই একটা বড় কারণ কিন্তু কোভিড গোকুলে বাড়ছে না সেটাই বা কে জোর দিয়ে বলতে পারে? রোগীদের লাইনে মাস্ক পরার অভূতপূর্ব সব কায়দা দেখে শিহরিত হচ্ছি। কারো মাস্ক মাথায় ফেট্টি করে বাঁধা। কেউ রোদ ঢাকতে চোখের ওপর আলতো করে বেঁধে নিয়েছেন। রুমাল হিসেবে মুখ মোছার কাজে লাগছে অনেকের। কেউ কব্জিতে বেঁধে মাচো-মাস্তানা। দাড়ির মতো ঝোলা কিংবা এক কানে মোবাইল অন্য কানে মাস্ক- এগুলো বেশ রেট্রো-স্টাইল হয়ে গেছে। ওগুলো আর ততখানি খাচ্ছে না। যদিও পুরাতনপন্থীরা সেসব ঐতিহ্য ধরে রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে সেসবের ঐতিহাসিক মূল্য মাথায় রেখেও নতুনকে মেনে নিতে হয়। তাই মাস্কের এককোণে থুতু লাগিয়ে নাকের ময়লা পরিষ্কার করা কিংবা মাস্ক দিয়ে প্যান্টের ধুলো ঝেড়ে নেওয়ার মতো নব্য-আবিষ্কৃত বিষয়গুলিকে বাড়তি গুরুত্ব দেওয়া উচিত। শোনা যাচ্ছে, মাস্কের ওপর লেখা প্রেমপত্রও বেশ জনপ্রিয় হয়েছে। “মাস্ক খুলে দ্যাখো না কে এসেছে/ স্যানিটাইজার হাতে মেখে গন্ধ শুঁকেছে” ইত্যাদি লাইন বাজারে এলে হটকেক হওয়া সুনিশ্চিত।
কোনও জমায়েত দেখলে বুঝতে পারি- গরুর দুধে আগে শুধু সোনা পাওয়া যেত। এখন সাথে প্ল্যাটিনাম আর হীরেও পাওয়া যায়। কোনও সমাবেশ থেকে বোঝা যায়- বিপ্লব আসবো আসবো করে অবশেষে এসেই পড়েছে। নেহাত লকডাউনে দেরি না হ’লে এতদিনে ঘরে ঘরে পৌঁছে যেত। কোনও মিছিলের মূল নির্যাস- এদ্দিন তো শুধু সাইকেল আর দু’টাকার চাল ছিল, এবার ক্ষমতায় এলে সবার জন্য হেলিকপ্টার। এত বিচিত্র রঙ্গমঞ্চে এত ভাবের খেলার মাঝে আমরাই শুধু গ্যাঁক গ্যাঁক করে চিল্লিয়ে মরছি কারণ ভয় দেখাতে পারলে ভ্যাক্সিন কোম্পানি কমিশন দেয়। শুধু আপনাদেরই কানে কানে বললাম। পাঁচকান হবে না সে বিশ্বাস আমার আছে।
যাক সে সব কথা… কেমন ধান ভানতে শিবের গাজন গেয়ে ফেললাম দেখুন। সময় সুযোগ হ’লে মাস্ক পরে বেরোনোর কথাটা একটু ভেবে দেখবেন। মারীর দেশের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র দৈত্য আবার মাস্ক খোলা মুখ দেখলেই ঠোঁটে জিভটা বুলিয়ে নেয়। তারপর চটচটে লালা সুড়ুৎ করে টেনে নিয়ে বলে- ‘খেলা হবে’!