অতুল চাকরি পেয়েছে। কেষ্টদাকে অনেক দিন ধরে বলা ছিল। সামান্য খরচ-খরচাও করতে হয়েছে। কন্ট্র্যাকচুয়াল যদিও।
ও কিছু না। আজকাল সব সরকারি চাকরিতেই দিতে হয়। শুধু কি চাকরি। শুনেছে পরীক্ষা পাশ করতেও টাকা লাগে। তাও আবার ডাক্তারির মত ভারি বিষয়ের অ্যানাটমি পরীক্ষা। ও পাড়ার ডাক্তারি পড়তে যাওয়া সন্তু তার এক ক্লাসে পড়ত। তার মুখে শোনা।
সে যাক গে যাক। চাকরিটা, হোক না কনট্রাকচুয়াল, কাঠখড় পুড়িয়ে পাওয়া যে গেছে, এই অনেক।
আজ চাকরিতে জয়েন করতে গেছে অতুল।
-নাম কি? শুধোলেন বড়কর্তা।
সামান্য লজ্জিত অতুল মাথা চুলকিয়ে, নামটা বলল।
ঘটনা হল, অতুলের নামটা একটু ইয়ে। নামটা ঠিক নয়, নামের পদবীটা।
এটা ঠিক, এই রকমের পদবী অনেকেরই আছে। যে যা পেশায় ছিল, তার থেকে পদবী। ক্রিকেটে যেমন নাকি নরি কন্ট্র্যাক্টর, ফারুক ইঞ্জিনিয়ার। আবার আলুওয়ালিয়া, দোকানিয়া। তা নিয়ে অন্যদের আক্ষেপ লজ্জা নেই। কিন্তু অতুলের আছে।
ওর বাপ ঠাকুদ্দা চোদ্দোপুরুষের পেশা চুরি। সেই করতে করতে ওদের পারিবারিক পদবি হয়ে গেছে চোরা। বংশের অন্য অন্য কেউ অবশ্য এফিডেবিট করে পদবী পালটে নিয়েছে। ঘোষ, রায়, বসু, দাস, মণ্ডল… যে যার ইচ্ছেমতো। কলকাতায় চলে গেছে রক্তধারার একটা শাখা। কালিঘাটের দিকে থাকে নাকি। পদবী পালটে ব্যানার্জি না বন্দ্যোপাধ্যায় কী যেন হয়েছে।
বাপ পিতামহ পদবী পালটানোর রাস্তায় যায়নি। ওর দাদু বিপুল চোরা। ওর বাবা সফল চোরা। এই সিঁড়ি বেয়ে অতুলের পুরো নাম অতুল চোরা।
নামটা শুনে বড়বাবু খিকখিক করে হাসলেন। – বাঃ বাঃ, বেশ নাম। বেড়ে নাম।
সদ্য আসা সিভিকের অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারটা হাতে নিয়ে হাসি বেড়ে গেল। আর খিকখিক বা খ্যাকখ্যাক নয়। এবারে অট্টহাসি। – চমৎকার!
অতুল ভেবেই পায় না এত হাসির কী হল।
হাসি থামলে বড়বাবুই বুঝিয়ে দিলেন। অতুল ক্লাস এইট অবধি পড়েছে। তারপরে বেশ কিছুদিন ফ্যা ফ্যা করে বেকার ঘুরল। পারিবারিক পেশায় ঢুকবে কিনা ভাবছে এমন সময়ে কেষ্টাদা বলল,
– ওরে অতুল, তোকে একটা চাকরি করে দিচ্চি। সরকারি চাকরিই, তবে মাইনে বেশি না। সে না হোক বাকিটা রাস্তায় দাঁড়িয়ে পুষিয়ে নিবি। দিনের আলোয় সবার চোখের সামনে। তোর ফ্যামিলির ইয়ে মানে পদবীটারও মজ্জাদা থাকে তাইলে।
ক্লাস এইট অবধি পড়া অতুল ইস্কুলে তার নামের বানান একটু অন্য রকম করে নিয়েছিল। মানে উচ্চারণানুগ আর কী! পাড়ার আর ইশকুলের প্রায় সবাইই ওকে ডাকে ‘অতুল’ নয় ‘ওতুল’ বলে। তাই ইংরেজিতে নামের বানানটা Atul নয় Otul Chora, ও নিজেই করে নিয়েছিল। স্কুলের সার্টিফিকেটেও সেই বানানই লেখা।
তা নামের সেই বানান দেখে বড়বাবু ভারি খুশি। মেজবাবু এএসআই ইসমাইলকে ডেকে বললেন, – আর চিন্তা রইল না হে, এই বারে আমার বদলে আরেকটা ওসি পেয়ে গেলে।
অ্যাঁ, তাই তো। আদ্যক্ষর জুড়লে তো নতুন এই সিভিক ছোকরা তো ওসিই বটে।
এবার ইসমাইলও হাসল। – ঠিকই স্যার, ওসিই বটে। তবে আমরা খাকি, ওরটা হবে নীল। এই যা তফাত।
মতলবি ওসি সাহেবের কাজের চাপ খুব। কথা না বাড়িয়ে খসখস করে অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারে সই করে দিলেন। অতুলের ডিউটি পড়ল ডাকবাংলার মোড়ে, কনিষ্ঠ গোপালদের সঙ্গে। ট্রাক আটকানোর ডিউটি।
★
তা চলছিল ভালোই যদ্দিন না। হ্যাঁ, যদ্দিন না বড়বাবুর অফিসে আবারও ডাক পেল সে। ইতিমধ্যে আমাদের অতুল বেশ সম্পন্ন হয়ে উঠেছে। বাইকে চড়ে অফিসে আসে। রাস্তায় ড্রাইভাররা স্যার বলে ডাকে ওকে।
বড়বাবু ওকে দেখে একটা খাকি উর্দি এগিয়ে দিলেন ওর দিকে। – একটু ট্রায়াল দিয়ে নাও তো। আমারই সেকেন্ড হ্যান্ড জামা প্যান্ট। তোমার মাপ আমার মাপ একই প্রায়।
অতুল আদেশ মত পোষাক বদলে এল। নীলের বদলে খাকি উর্দি। হোক না কন্ট্র্যাকচুয়াল। তবু স্বপ্নের উর্দি পরতে পারা ভাগ্যের ব্যাপার বইকি।
বড়বাবু ওকে দেখে খুশি হলেও মেজবাবু সাবধান করল চোখ পাকিয়ে, – পরে থাকিস না। স্রেফ যে দিন আমরা পরতে বলব, খালি সেদিনই পরবি, বুয়েচিস? আর ধরা পড়লে নিজের নামটা সাঁটে বলবি।
★
আজ খাকি উর্দি পরে ডিউটিতে উদয় হয়েছে আমাদের অতুল। কারণ আছে। বড়বাবু মানে ওসি সাহেবেরই হুকুমে। আজ তার হাতে বেআইনি যদিও, লাঠি রয়েছে। বড়বাবু গোঁফ নাচিয়ে বলেছেন,
– লাঠি কী রে, ফোর্সে লোক নেই মোট্টেই। কপাল থাকলে বন্দুকও পেতে পারিস।
★
কিন্তু উর্দিপরা হলে হবে কী, ওর থোবড়াটাতো লোকাল চায়ের দোকান পানের দোকান অনেকেই চেনে। সেই শালারা কেউ চুকলি খেয়েছে খবরওলাদের ক্যামেরা বাগানো লোকগুলোর কাছে।
সেই ক্যামেরাওলা লোকগুলো ছবি তুলে শুধোলো, – শুনলাম নাকি নীল পোষাক না পরে খাকি উর্দি পরেছেন! কী নাম আপনার?
অতুল (পাঠকের খেয়াল থাকতে পারে, অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার মোতাবেক Otul Chora মানে O.C.), তার ওপর যা নির্দেশ মান্য করে বুক ফুলিয়ে সাঁটে নামটা বলল, ক্যামেরায় ধরাও রইল সেই নাম।
অতুল বলল, – আমার নাম ওসি।
চমৎকার!
দারুন দারুন ৷ কালীঘাটের দিকে …!