ইদানীং রোগের চিকিৎসার থেকে রোগীদের ভুল ধারণার শেকড় উপড়ে ফেলতে বেশি কষ্ট করতে হয়। ইন্টারনেটের যুগে সবাই নেট আউড়ে রোগ নিয়ে কম বেশি জেনেই আসেন। কিন্তু সে জ্ঞানের বেশিরভাগই স্বল্পতার দোষে ও ইন্টারনেটের জালে জড়িয়ে এক্কেবারে ঘেঁটে ‘ঘ’।
গেল সপ্তাহে সুপ্তি এসেছিলো ডান হাতের কনুইয়ের ব্যথা নিয়ে। সদ্য বিবাহিতা। নতুন সংসারে নিজের উপযোগিতা প্রমাণ করার লক্ষ্যে দিনভর ঘর গুছিয়েছে। দুদিন ধরে সারাবাড়ি ঝুল ঝেড়েছে। কাপড় কেচেছে। কিচ্ছুটি হয়নি ডাক্তারবাবু। কিন্তু যেইই না গতকাল আবার কাপড় কেচে নিঙড়াতে গেছে, ডান হাতের কনুইয়ে কনকনিয়ে যন্ত্রণা শুরু হয়েছে। পাশের বাড়ির এক গুগলসেবির পরামর্শে গরম সেঁক নিয়েছে। ব্যথার ওষুধও খেয়েছে। আমরা তো এ যুগের আধুনিক মানুষ। তাই তার সাথে গ্যাসের ওষুধ খেতেও ভোলেনি ডাক্তারবাবু। কিন্তু আজ ভোর থেকে একেবারে কঠিন অবস্থা। কব্জি প্রসারণে এক্কেবারে ঝিনঝিনিয়ে উঠছে কনুইয়ের জায়গাটায়। পাড়ার ডাক্তারের পরামর্শে কনুইয়ের এক্স-রে ও করিয়ে এনেছি ডাক্তারবাবু। কিন্তু এক্স-রে দেখে তিনি বিশেষ কিছু বুঝতে পারছেন না বলে আপনার কাছে নিয়ে এলাম।
সদ্য দায়িত্ব পাওয়া স্বামীর থেকে সবটা শুনে নিয়ে সুপ্তির ডান হাতের কনুইটা টেনে অস্থিসন্ধির এক বিশেষ জায়গায় চাপ দিতেই যন্ত্রণায় কঁকিয়ে উঠলো সুপ্তি। কব্জি জয়েন্টের এক্সটেনশন করানোর চেষ্টা করাতেও একই অবস্থা।
এমনি সময় প্রায় কিছুই ছিলো না ডাক্তারবাবু। শুধুমাত্র কাপড় নিঙড়ানো আর ভারি বালতি তোলার সময় ছাড়া বাকি সময় ঠিকই ছিলো। কাল রাত থেকে বেড়েছে।
বুঝলাম, সুপ্তি নিজের এ ব্যথার দায়ে অভিযুক্ত। গৃহকর্মে নিপু্ণতা না দেখাতে পেরে লজ্জিতাও বটে।
বললাম, প্রথমত রেষ্ট নিতে হবে। এর বিকল্প আপাতত কিচ্ছু নেই। বরফের সেঁক নিতে হবে। গরম সেঁক এই মুহূর্তে ব্যথার পরিসর বাড়িয়ে দেবে। পাশের অর্থোসার্জিক্যাল দোকানে গিয়ে “টেনিস এলবো ব্রেস” নিয়ে এসো। লাগিয়ে রাখলে অনেকটাই কমবে। কিছু ওষুধ লিখে দিচ্ছি, যদিও ওষুধে পুরোটা কমবে না। রেষ্ট নেওয়াটাই এক্ষেত্রে মূল চিকিৎসা।
আমার কথায় খুব সন্তুষ্ট না হয়েও পাশের দোকান থেকে ব্রেসটা নিয়ে এলো সুপ্তির বর। কনুই জয়েন্টের দু‘আঙুল নিচে ব্রেসের চ্যাপ্টা অংশটা নির্দিষ্ট স্থানে রেখে বেঁধে দিলাম। স্নানের সময় আর ঘুমোনোর সময় ছাড়া বাকি সময় এটি বেঁধে রাখতে হবে।
এতেও যদি না কমে, তাহলে হাড়ের ভেতর ইঞ্জেকশন (ইন্ট্রা-আরটিকুলার স্টেরয়েড) দেওয়া ছাড়া গতি নেই।
এই শেষ লাইনটা বলে রাখলাম, যাতে টেনিস এলবো ব্রেসটা নিয়ম করে বেঁধে রাখা হয়।
সুপ্তি চলে যাবার পরেই চেপে ধরলো চেম্বারের অ্যাসিস্ট্যান্ট ছেলেটি। বছর দুয়েক আগে এই ব্যথায় মায়ের কনুইয়ে চারটি ইঞ্জেকশন দিতে হয়েছিলো। ব্যাপারটা যদি একটু খুলে বলেন।
টেনিস এলবো। মেডিক্যাল পরিভাষায় “ল্যাটারাল এপিকন্ডাইলাইটিস”। মূলতঃ এক্সটেনসর কারপাই রেডিয়ালিস ব্রেভিস পেশির অতিব্যবহার হেতু টেন্ডিনোপ্যাথি। সহজ কথায় টেনিস এলবো। এর মানেই যে শুধুমাত্র টেনিস প্লেয়ারদেরই এই ব্যথা হবে, তা নয়। শচীন টেন্ডুলকরের খেলোয়াড় জীবনের শেষে শচীন এই রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। প্রথমে রেষ্ট নিয়ে খানিক কমলেও অবশেষে তাঁর খেলার অঙ্গসজ্জার এক প্রধান বর্ম ছিলো কনুইয়ের নিচে বাঁধা এই টেনিস এলবো ব্রেস। নিয়মিত ফিজিওথেরাপি ও আলট্রাসাউন্ড রে নিলেও কিছুক্ষেত্রে উন্নতি ঘটে। ইন্ট্রা-আর্টিকুলার কর্টিকোস্টেরয়েড ইঞ্জেকশনও একটা উপায় বটে। এরকম অনেক রকম ভাবে এর ট্রিটমেন্ট করা গেলেও কোনোটিই সম্পূর্ণ ভাবে একে সারাতে পারে না ।
বিশ্রামই মূলমন্ত্র।
হপ্তা তিনেক বাদে সুপ্তি এলো পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের প্রসাদ দিতে। বিশ্রাম নিতে বলায় ওরা পুরী বেড়াতে গেছিলো। প্রভু জগন্নাথের কৃপায় ব্যথা কমেছে। আর আমার বিশ্রাম নিতে বলার পরামর্শের দৌলতে এই ফাঁকে একটু বেড়িয়ে আসতে পেরেছে সে। সে কৃতজ্ঞতা স্বরূপ এ প্রসাদপ্রাপ্তি। বিস্ময়ে অজান্তেই হাঁ হয়ে যাওয়া মুখে প্রসাদ খানা চালান করে দিলাম নিস্তব্ধে। জয় জগন্নাথ।