কথা হচ্ছিল ব্যর্থ প্রেম নিয়ে। চার বন্ধু বসেছিল হপ্তা শেষের সন্ধ্যায়। ওদের বয়সের তফাত অনেক। একপাশে সূর্যশেখর, দীর্ঘদিন রিটায়ার্ড। আর অন্যপাশে সর্ব কনিষ্ঠ তৃষিত, সূর্যর বড়ছেলের চেয়ে মোটে কয়েক মাসের বড়। সূর্যকে ডাকে স্যার বলে। তবু তারা চারজন বন্ধু।
আড্ডায় তরল পানীয় চলে। অসঙ্কোচ কথাবার্তা হয়। আজকের টপিক ঠিক করেছে তৃষিত।
বেচারা এখনও বিয়ে করে উঠতে পারেনি। গোটা কয়েক লিভ ইন পার্টনারশিপ সাঙ্গ করে সে তার সাম্প্রতিক ব্রেক আপের শোক সামলাচ্ছে।
একে প্রেম তায় ব্যর্থ! টক ঝাল মিষ্টি… শরীর মনের গল্প শোনা যাবে এই ভেবে সবাই উত্তেজিত। শুরুতেই শর্ত হয়েছে সবাই নিঃসঙ্কোচে যা বলার সব বলবে। কিচ্ছু রাখঢাক করবে না কেউ।
ব্যর্থ প্রেমের কান্না? হ্যাঁ, তাতো থাকতেই হবে!
প্রথম শুরু করল তৃষিতই। তার একখানা ব্যর্থপ্রেম তো নয়! চার চারখানা অ্যাডাল্ট প্রেম আর তার আগের হাফডজন কাফ লাভ। পুরোটা শুনতে গেলে রাত কাবাড় হয়ে যাবে। তাই তাকে স্ট্রিকচার দিতে হবে ভেবেছিল অন্যরা। কিন্তু যা বোঝা গেল শেষ ব্রেক আপের হ্যাং ওভার তাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। তো সেটার কাহিনিও যথেষ্ট উত্তেজক। ঘরকন্না আঁচড়কামড় অ্যাক্রোবেটিকস এমন কী কন্ডোমের পছন্দ অপছন্দ মিলিয়ে সে এক মহাকাণ্ড।
পরের দুজন সুভাষ আর দিবাকর। গলায় ঢালা রাশি রাশি তরলে গুলে তাদের প্রায় পাথর ফসিল হয়ে যাওয়া ব্যর্থ প্রেম পরিবেশন করল তারা।
সুভাষের সম্বল শুধু খানকতক চুমু আর চিঠি।
দিবাকর বিছানা অবধি এগিয়েছিল। বিছানা ঠিক না। ওকালতি পড়তে পড়তে গ্রামের বাড়ির আমবাগানে। বনতল ফুলে ফুলে ঢাকা টাইপের শোয়া। শিউলির বিয়ে হয়ে যায় পরের মাসেই। উকিল দিবাকরের সন্দেহ শিউলির ছেলেটি তারই ছেলে। নিজের ছেলের মামা হয়েছে সে।
রাত গড়াচ্ছে। মেঝেতে গড়াচ্ছে গেলাস। সূর্যশেখরের তরল পদার্থে রুচি নেই।
বাকি তিন অসংলগ্ন সঙ্গীদের এবার তার গল্প শোনাবে সত্তর ছুঁই ছুঁই সূর্যশেখর। কাকে বলে প্রেম? প্রেমের কী বোঝে এই প্রায় সেদিনের ছেলেরা? প্রেম কী শুধুই একটা পুরুষ একটা মেয়ে? আর তাদের মাঝের ভঙ্গুর পাতা অথবা আদৌ না পাতা বিছানা?ওটা প্রেমের একটা অতি ছোটো প্রকাশ। মাতালগুলো শোনার অবস্থাতেই নেই হয় তো!
তবু বলতে শুরু করে সে। – ভালোবাসার রকম-সকম? রসবেত্তারা প্রেমের পাঁচ রকম ভাগ করেছেন। প্রথমটা মধুর মানে তোরা যেটা বুঝিস। তারপরে সখ্য মানে বন্ধুত্ব। এছাড়াও শান্ত দাস্য। আর সবশেষে যা সেটা তোরা কেউই সে ভাবে ভাবলি না। সেটা হল বাৎসল্য। কীরে শুনছিস তো তোরা? সন্দেহ হয় সূর্যর।
কিন্তু বিড়বিড় করা গল্পটা বলে চলে। তার হেরে যাওয়া বাৎসল্যের গল্প। – আমার একটা মেয়ে বাচ্চার জন্য খুব ঝোঁক ছিল। অন্যদের বাচ্চা মেয়ে দেখলেই জনে জনে জিজ্ঞেস করতাম মা হবি আমার?
একদম বিয়ের পরপরই ছয়মাসের মধ্যে পেটে বাচ্চা এলো তোদের বৌদির। তখন সংসারের টালমাটাল অবস্থা। সেই বাচ্চাটাকে নষ্ট করে ফেললাম আমরা। সেই তখন, ল্যাম্পপোস্টে বিজ্ঞাপন দেখা যেত এই ব্যাপারে। এত খুল্লম খুল্লা ছিল না ব্যাপারস্যাপার। যাই হোক নিজের ঘোর অনিচ্ছায় বৌয়ের চাপে, ল্যাম্পপোস্টে দেখা শ্রীকৃষ্ণ নার্সিং হোমে, ঋতু পরিষ্কার করে নেওয়া হল। নার্সিংহোমের ওরা দেখালও।
সূর্যর বিশ্বাস ওদের দেখানো তখনও জেলির মত, সেই অগঠিত ভ্রূণটা ছিল তার কন্যা সন্তানের।
এর পর দুটি ছেলে হল। সেই হারিয়ে যাওয়া কন্যা কিন্তু এল না ঘরে।
– না এলো না … সেই যে এসেছিল … আমি কোলে নিতে রাজি হইনি বলে রাগ করে আর এলোই না আমার কাছে।
সূর্য ভাবছিল কেউই শুনছে না ওর এই বিড়বিড়ানি। ভুল ভাবছিল।
তৃষিত নতুন করে গেলাস ভরতে ভরতে বলল, – ফের শুরু করলেন? আপনি তো ছেলের বিয়ে দিয়েছেন। বৌমাকে মেয়ে ভাবুন না!
– নারে তৃষিত, ছেলের বিয়ে দিয়ে পুত্রবধূ পেয়েছি, মেয়ে পাইনি! তবু সেই কন্যাসন্তানের তৃষ্ণা যায়নি।
– যাঃ শালা, এই তোমার ব্যর্থ প্রেমের গল্প? অবজেকশন! বলল সুভাষ।
উকিল দিবাকর বলল, – আরে, তৃষ্ণা আছে তো! অবজেকশন ওভাররুলড্…
দিবাকর যদি কথাটা নাও বলত, সূর্য বলতই। – রিটায়ারমেন্টের বছরখানেক আগে আপিসে নতুন চাকরি পেয়ে এল এক কন্যা। পুরোনো অভ্যাসে যেই না বলেছি, মা হবি আমার? মেয়ে এককথায় রাজি।
ভারি স্মার্ট মেয়ে। ফেসবুক ইন্সটাগ্রাম আর হোয়াটসঅ্যাপে সদাব্যস্ত।
আপ্লুত সূর্য তখন জাঁক করে চেনাজানা সবাইকে বলত, জানো আমি অ্যাদ্দিনে মেয়ে পেয়েছি একটা।
আর সেই মেয়ে? সে তখন তার এই নতুন সংগ্রহ করা পুতুলের নাকাল অবস্থা দেখে অফিসে আর বাইরেও রটাতে শুরু করল সূর্যশেখর হাবুডুবু খাচ্ছে শুধু না, অসংগত কামার্ত প্রস্তাবও করেছে। সূর্য জানত না এইটাই ভার্চুয়ালের জগতে দস্তুর।
যখন জানল, তদ্দিনে সূর্য পরিচিত মহলের ফিসফিসানিতে আর খাপপঞ্চায়েতে বেশ প্রতিষ্ঠিত লম্পট।
— তারপর?
—- চুকেবুকে গেছে সব, যেমনটি যাবার কথা।
সূর্য চোখ মুছল।
হাঁ হাঁ করে উঠল তিন জুনিয়ার। – এই সূর্যদা, কাঁদছেন নাকি?
আঃ, আজকাল এত সহজেই চোখে জল আসে কেন?
অনবদ্য