‘ব্রেন ডেথ’ কি?
অরুণা শানবাগের euthanasia-র মামলা ২০১১ সালে অনেকদিনের একটি অস্বচ্ছ ধারণাকে স্বচ্ছ করে দেয়। ব্রেন ডেথ বা মস্তিষ্কের মৃত্যুর সংজ্ঞা বলছে – An irreversible cessation of all functions of the brain including the brainstem. ব্রেন স্টেম হল মস্তিষ্কের সেই অংশ যা দিয়ে মস্তিষ্ক ও বাকি শরীরের স্নায়বিক সংযোজন থাকে। অরুণা শানবাগের মামলায় কোর্টের রায় হয়, মস্তিষ্কের মৃত্যু মানেই ব্যক্তির মৃত্যু, এ নিয়ে দ্বিমত থাকা উচিত নয় আর। শুধুমাত্র মরণোত্তর অঙ্গদানের ক্ষেত্রেই এটি প্রযোজ্য নয়। সময় ও পরিস্থিতির সাপেক্ষে চিকিৎসাধীন অন্য রোগীর ক্ষেত্রেও এটি ব্যবহার করা যাবে।
বলা বাহুল্য, ব্রেন ডেথ ঘোষণা করার ক্ষেত্রে বেশির ভাগ সময়েই ভুল ধারণা কাজ করত এতদিন। যেমন ডাক্তারদের মধ্যে, তার চেয়েও বেশি, আত্মীয় পরিজনদের মধ্যে। ব্রেন ডেথ কথাটা মুড়ি -মুড়কির মত বলে ফেললে হয় না। হাসপাতালের কোন এক কোণে কোথায় কে কখন মুখ ফসকে কথাটা একবার বলেছে। সে ছোট্ট অনভিজ্ঞ নার্স দিদিমণিটিও হতে পারে অথবা লিফটম্যান। পাড়া-প্রতিবেশী-বন্ধু -অফিস কলিগ যারা শেষ অবস্থায় অসুস্থ মানুষটির শরীর ছুঁয়ে দেখেছেন, এসে বলছেন – “গা তো একেবারে মড়ার মত ঠান্ডা গো! ব্রেন ডেড হয়ে গেছে হয় তো। ভেন্টিলেশনে তাও দিয়ে রেখেছে কেন?” তারপরই যা হয়, তাকে বলে স্নো-বলিং। হাসপাতাল বিল বাড়ানোর জন্য ভেন্টিলেশনে মৃতদেহকে ফেলে রেখেছিল! মারা গেছে সেটা আজ বলছে! বিক্ষোভ, অবরোধ, ভাঙচুর, ঘেরাও! তারপর মিডিয়ায় তুষারধ্বস!
ডাক্তার ও আত্মীয় উভয়কেই এই দোলাচল থেকে রক্ষা করতেই আইনের সংশোধন, পুনর্গঠনের প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছিল৷
কেরল এ দেশে সর্বপ্রথম চালু করছে এই নিয়ম। ভেন্টিলেশনে দেওয়া রুগীর ক্ষেত্রে, কেরলের স্বাস্থ্যব্যবস্থায় এই জানুয়ারি তেই প্রোটোকল যুক্ত হয়েছে,যে,
– যার মস্তিষ্কের মৃত্যু সম্বন্ধে নিঃসন্দেহ ও নিশ্চিত হওয়া গেছে, তাকে দ্বিধাহীনভাবে “ব্রেন ডেড” ঘোষণা করে দেওয়ার অধিকার ডাক্তারদের হাতে থাকছে। ব্রেন ডেড মানেই ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে এ নিয়ে আর দ্বিমত নেই । এরপর অর্গান ডোনেশন হবে কি হবে না সেটা পরবর্তী পদক্ষেপে ভাবা যেতে পারে। যদি অর্গান ডোনেশন না হয়,তাহলে ডাক্তাররা ব্রেন ডেড ঘোষণা করার পর ভেন্টিলেশন থেকে রোগীকে বিচ্ছিন্ন করে দিতে পারেন। যাকে আক্ষরিক অর্থে বলা হচ্ছে Withdrawal of Life Support. এতে আর মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত আত্মীয়দের আইনানুগ সম্মতি নেবার কোন প্রয়োজন নেই। দেশের সব কটি রাজ্যে এই নিয়ম এখনো গৃহীত হয়নি।
আত্মীয়রাও জেনে রাখুন যে হঠাৎ করে নাটকীয় কায়দায় ডাক্তার ICU বা OT র দরজা ঠেলে বেরিয়ে এসে “ওনার ব্রেন ডেথ হয়ে গেছে ” এভাবে ঘোষণা টা কখনোই করবেন না। সব কিছুই হবে স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রোটোকল অনুযায়ী( SOP)।
কি সেই প্রোটোকল?
এই প্রোটোকল এ দেশের সর্বত্র ব্রেন ডেড ঘোষণার ক্ষেত্রে প্রয়োগ হয়।
অন্যান্য রাজ্যের মত পশ্চিমবঙ্গে এখন শুধু হচ্ছে অর্গান ডোনেশনের আগে।
১) রেজিস্টারড হাসপাতাল গুলিরও সেই সমস্ত রোগীদের যারা ট্রান্সপ্লান্ট এর জন্য অপেক্ষা করছেন, এদের তালিকা থাকে রাজ্যের ও কেন্দ্রের ।
২) এই তালিকা অনুযায়ী, অরগান ট্রান্সপ্লান্ট নিয়ন্ত্রণ করার জন্য প্রতি রাজ্যের নিজস্ব বিশেষ কয়েকটি কমিটি থাকে। মরণোত্তর অঙ্গদান অথবা জীবিত অবস্থায় অঙ্গদান সমস্তটাই এতে অন্তর্ভুক্ত ৷ ৩) রেজিস্টারড হাসপাতালে বিশেষজ্ঞদের একটি দল আগে সম্ভাব্য ব্রেন ডেড রোগীর শারীরিক অবস্থা খতিয়ে দেখেন ও তাকে অর্গান ডোনেশনের জন্য চিহ্নিত করেন।
৪) বিশেষজ্ঞদের এই দলটি এবং সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক ও হাসপাতালের অভ্যন্তরীণ অরগান ডোনেশন কমিটি দফায় দফায় রোগীর আত্মীয়দের সঙ্গে কথা বলেন, ব্রেন ডেথের সম্ভাবনার কথা জানান এবং অর্গান ডোনেশনের প্রস্তাব রাখেন। এ ক্ষেত্রে কখনো কোনভাবেই প্রলোভন দেওয়া বা জোর করা হয় না। রোগীর আত্মীয়ের শুভ ইচ্ছা ও মহানুভবতার ওপরই সব কিছু নির্ভর করে।
৫) যদি বাড়ির লোকের কাছ থেকে সম্মতি আসে, তাহলে অঙ্গদান সংক্রান্ত সংশ্লিষ্ট এই কমিটিগুলিকে রিপোর্ট করা হয়।
৬) এরপর ব্রেন ডেথ সম্পর্কে নিশ্চিত হতে হয় চিকিৎসা শাস্ত্র অনুযায়ী বেশ কয়েকটি পরীক্ষা করে ধাপে ধাপে, যা পরবর্তী ২৪ ঘন্টার মধ্যে করা হয়৷ সংক্ষেপে বলার, একটি হল Apnea test যাতে নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে রোগীকে ভেন্টিলেটর থেকে বিচ্ছিন্ন করে, রক্তে কার্বন ডাই অক্সাইডের বৃদ্ধির মাত্রা একটি নির্দিষ্ট মাপকাঠির সঙ্গে তুলনা করে দেখা হয়।
৭) ব্রেন ডেথ সম্বন্ধে নিশ্চিত হলে তা নথিবদ্ধ করা হয় আইনি পদক্ষেপ অনুসারে, তবেই পরবর্তী প্রক্রিয়া অর্থাৎ সার্জারি এবং খরচ সংক্রান্ত অন্যান্য বিষয়গুলি নিয়ে রোগীর পরিবারের সাথে আলোচনা হয়। রোগীর আত্মীয়েরা মরণোত্তর অঙ্গদানে সম্মতি দেবার পর হাসপাতালের পরবর্তী খরচ হাসপাতাল বা সংশ্লিষ্ট সংস্থা, গ্রহীতা, সরকার, NGO প্রভৃতি বহন করেন। অঙ্গদাতাকে কোন খরচ করতে হয় না।
এবার, প্রসঙ্গতঃ আলোচনা করতেই হবে সে সমস্ত আত্মীয়ের বিড়ম্বনার কথা যাঁরা অঙ্গদানে সম্মতি দেন নি। আবার হাসপাতালের খরচ নিয়েও আর পেরে উঠছেন না। যাঁরা সম্মতি দিলেন, তাঁদের শুভ ইচ্ছা নিয়ে তো কোন সন্দেহ নেই। এরকমও হয়, যে সদিচ্ছা প্রকাশ করলেও, আসলে শারীরিক অবস্থার জন্য শেষ পর্যন্ত অঙ্গদান সম্ভব হয় না। আবার রোগীর আত্মীয় অঙ্গদানে সম্মতি দেননি বলে – ‘ইশ কি খারাপ লোকজন’ এ কথা ভাবার কোন জায়গা নেই।
আর যে সমস্ত রোগী অন্যান্য টার্মিনাল অসুখে ভুগছেন? মাল্টি অর্গান ফেলিওরের শিকার? যাদের বেঁচে ফিরে আসার সম্ভাবনা ক্ষীণ, আবার ব্রেন ডেথও হয়নি? এই সমস্ত ক্ষেত্রে আর্থসামাজিক দিকটার কথাও ডাক্তারদের ভাবতে হয়। সব সময়েই। এ ক্ষেত্রে হাসপাতালের দিক থেকে একটি সহজ উপায় থাকে রোগীর আত্মীয়দের বন্ডে সই করে চলে যাওয়ার কথা বলা। কেউ কেউ মৃত্যু অবধারিত জেনে বাড়িতে নিয়ে যান। আর্থিক সামর্থ্য থাকলেও প্রিয়জনের শারীরিক যন্ত্রণা ও আবেগের কথা ভেবে নিয়ে চলে যান কেউ কেউ। কিন্তু মূল কারণটি বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই আর্থিক। কেউ কম খরচের হাসপাতালগুলিতে বা সরকারি হাসপাতালে হন্যে হয়ে শয্যার খোঁজ করতে থাকেন। সংশ্লিষ্ট হাসপাতালের আর কোন আইনগত দায় বিশেষ থাকে না ঠিকই, আত্মীয় দের ভোগান্তি চরম সীমা ছাড়িয়ে যায় অনেক সময়েই।
তাহলে উপায় কি? Withdrawal না Withholding?
যতদিন না সমস্ত দেশে Withdrawal of Life Support নিয়ে একটি স্পষ্ট আইন লাগু হচ্ছে, ততদিন একটি মধ্য অবস্থান নেবার কথা মেডিকোলিগ্যাল বিশেষজ্ঞরা বলে আসছেন ।একে বলা হচ্ছে Limiting Life Support interventions.
এর মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত হচ্ছে-
Withholding of Life Support. রোগীর শারীরিক অবস্থা বিচার করে, ডাক্তার আর আত্মীয় নিজেদের মধ্যে সমস্ত আর্থ সামাজিক দিকগুলি সবিস্তারে আলোচনা করে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছান, যে কোন নতুন চিকিৎসা পদ্ধতি বা পরীক্ষা নিরীক্ষা, নতুন কোন ওষুধ বা ফ্লুইড বা নিউট্রিশনাল থেরাপি, ডায়ালিসিস, জীবনদায়ী ওষুধ বা প্রক্রিয়া (কার্ডিওপালমোনারি রিসাসিটেশন বা CPR) প্রয়োগ করা হবে না। এতে শেষ পর্যন্ত যে রোগীর মৃত্যু হবে এই বোঝাপড়া ডাক্তার-রোগী উভয়পক্ষেরই থাকবে।
এতে আইনগত জটিলতা একটু কাটে। প্রতিদিনের খরচ ও তুলনা মূলক ভাবে কমে যায়। কিন্তু এই সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে রোগীর আত্মীয় হিসেবে, প্রচণ্ড অন্তর্দ্বন্দ্বের সম্মুখীন হতে হয়।
“এ যেন একরকম মৃত্যু পরোয়ানায় সই করলাম ” বলে অনেক আত্মীয়কে অসহায় ভাবে কান্নায় ভেঙে পড়তে দেখেছি চোখের সামনে।
ডাক্তার হিসেবে মানসিক ভাবে আত্মীয়দের পাশে দাঁড়ানো এক্ষেত্রে ভীষণ ভীষণ প্রয়োজন। সাইকো-লজিক্যাল কাউন্সেলিং ও অনেকটা সাহায্য করতে পারে।
…..
ভেন্টিলেশনে দেবার ও বের করবার সমস্ত চিকিৎসা শাস্ত্র সম্বন্ধীয় সিদ্ধান্তগুলি ছাড়াও, একজন ডাক্তারকে প্রতিদিন নিজের কার্যক্ষেত্রে সম্মুখীন হতে হয় নানান দ্বন্দ্বের সামনে। রোগীকে হাসিমুখে বাড়ি পাঠানোর ইচ্ছে থাকে, রোগীর নিকটাত্মীয়দের দেখে নিজের বাড়ির লোকজন, নিজের ছোট্ট বাচ্চার কথা, মা বাবার কথা, ভাই বোনের কথা, ভালোবাসায় মানুষটির কথা, অনেক সময় মনে পড়ে। দীর্ঘকালীন অসুস্থতায় ভোগা মানুষগুলির আত্মীয় ও পরিবারও কি গভীর মানসিক অসুখে ভোগে, এ কথা দিনরাত রোগীর বিছানার পাশে অতন্দ্র প্রহরীর মত দাঁড়িয়ে থাকা ডাক্তার আর নার্সরা ছাড়া আর কেউ বোঝে না। কর্পোরেট বা প্রাইভেটাইজেশন, স্বাস্থ্যবীমা,স্বাস্থ্যবাজেট, সরকারি সমস্ত সুব্যবস্থা, সবই অপ্রতুল মনে হবে, শুভবুদ্ধি আর মানুষের মানুষকে সাহায্য করার ইচ্ছে না থাকলে। আরো ক’হাজার বছর লাগবে সেই দিন আসতে, কি জানি! স্বপ্ন দেখা আর রোগীর পাশে থেকে রাত জাগা ছাড়া ইনটেন্সিভিস্ট হিসেবে আর কিছুই আমাদের করণীয় নেই এখন।