পায়ে হেঁটে যাতায়াত করাটা বিদ্যাসাগরের চিরাচরিত অভ্যেস ছিল। বোধহয় উপভোগও করতেন। বীরসিংহ থেকে কলকাতা প্রায় বিশ ক্রোশ, হেঁটেই যাতায়াত করতেন। ভোর ভোর যাত্রা শুরু করতেন। মাঝে দু’এক জায়গায় একটু জিরিয়ে নিতেন। তেমনই একটা দিনের গল্প তাঁর নিজের মুখে।
“আমি একদিন বাড়ি যাবার সময় দুপুরের রোদে কিঞ্চিৎ বিশ্রামের জন্য একটি খোড়ো বাড়ীর বাহিরের রোয়াকে বসে আছি, এমন সময় বাড়ীর ভেতর থেকে গুটি দুই তিন ছেলে নাচতে নাচতে আর গানের সুরে চেঁচাতে চেঁচাতে বেরিয়ে এল। তাদের মুখে এই বুলি- আজ আমাদের ডাল হয়েছে, আজ আমাদের ডাল হয়েছে। আমি ত দেখে শুনে অবাক। ভাবলুম যে, এদের এত দুরবস্থা যে বছরের মধ্যে পাল পার্ব্বণের মত দু’এক দিন ডাল রান্না খেতে পায়। আর বোধ হয় এমন অনেকেই আছে।”
বক্তা বিদ্যাসাগর আর শ্রোতা কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্য, বিখ্যাত দার্শনিক পন্ডিত, বিদ্যাসাগরের অন্যতম প্রিয় শিষ্য, সুহৃদ। কৃষ্ণকমল এই কথোপকথনের বিবরণ দিতে গিয়ে বলছেন যে গল্পটা বলতে বলতে বিদ্যাসাগরের দুই চোখ দিয়ে অঝোরে জল পড়ছে।
আরো অনেক ঐতিহাসিক চরিত্রের মতো বিদ্যাসাগর মশাইয়েরও বস্তুনিষ্ঠ মূল্যায়ন আমরা বাঙালিরা করে উঠতে পারিনি। হয় তাঁকে ঈশ্বর টিশ্বর বানিয়ে মাথায় তুলে নেচেছি অথবা মুৎসুদ্দী বুর্জোয়া কলাবরেটর বানিয়ে তাঁর মুন্ডুপাত করেছি মূর্তির মাথা কেটে। এই দুই এর মাঝে মানুষ বিদ্যাসাগর কোথায় যেন হারিয়ে গেছেন। একটু চেষ্টা করলেই কিন্তু তাঁকে খুঁজে পাওয়া যায়।
আমরা যারা দিনবদলের স্বপ্ন দেখি, স্বপ্ন দেখি সবার ঘরে ঘরে রোজ চাট্টি ডাল-ভাতের ব্যবস্থা হবে একদিন না একদিন, যারা সেই প্রত্যয় থেকে শ্রমজীবী ক্যান্টিন চালাই, জাতের বদলে ভাতের লড়াইকে চ্যাম্পিয়ন করতে চাই, তাদেরই দায়িত্ব এই মানুষ বিদ্যাসাগরকে খুঁজে বের করা, তাঁর জীবন থেকে অনুপ্রাণিত হওয়া। খেটে খাওয়া মানুষের লড়াইতে বিদ্যাসাগর আমাদের সাথে থাকবেন। তাঁকে বাদ দিয়ে এ লড়াই করা যায় না। তাঁর জন্মদিনে আমাদের চোখের জলের শপথ।